শাহাদুজ্জামানের পরিচয়, আমার কল্পজগতে, লেখক। গল্পকার, ঔপন্যাসিক, কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক প্রভৃতি পরিচিতিগুলোকে কখনো বিশেষণ, কখনোবা পদবি মনে হয়। আমি লেখাকে লেখা হিসেবেই দেখি, তার ধারা হতে পারে ২টি- ফিকশন এবং নন-ফিকশন। কে কাব্য রচনা করছে, আর কে গল্প বা উপন্যাস– এইসব বিশেষায়নে পড়ার বা চিন্তার স্বতঃস্ফূর্ততা বিনষ্ট হয়,ধারণা আমার।

শব্দশিল্পী কাউকে আমি দেখি এভাবে- তিনি লেখক তবে কাব্যঘরানায় বেশি লেখালিখি করেন, বা তার লেখার যে ফর্ম তাতে সীমিত পরিসরের ফর্মে তার চিন্তা আর প্রকাশভঙ্গির নিজস্বতা বেশি পাওয়া যায়, বড়ো পরিসরের ফর্মে তার নিজস্বতা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। কিংবা ফিকশনের চাইতে নন-ফিকশনে তার পর্যবেক্ষণগুলো প্রাণবন্ত লাগে বেশি।

কোন্ ফর্মে লিখছেন তা আদৌ বিবেচনায় নিই না,বরং নাম না দেয়া অবস্থাতেও কোনো লেখা পড়ে যদি লেখককে সনাক্ত করা যায় এবং পর্যবেক্ষণ, চিন্তাশক্তি আর উপস্থাপনে নিজস্বতা পাই- তাকেই গুরুত্বপূর্ণ লেখক মনে করি। ভালো লেখক, মন্দ লেখক বিভাজন দিয়ে লেখকের মানস ধরা যায় বিশ্বাস করি না, লেখক হয় গুরুত্বপূর্ণ অথবা গড়পড়তা।

তবে মার্কেট ইকোনমিক্স অনিবার্যতায় কেবল গুরুত্বপূর্ণ আর গড়পড়তা ট্যাগে একজন লেখককে সাব্যস্ত করা যায় না; ব্যবসাসফল এবং ব্যবসাহীন- এই দুটো শর্তকেও আমলে নিতে হয়। লেখককে ব্যবসাসফল হতে হলে সেই দেশের সংস্কৃতি, গড় মানুষের মেধা-মনন-রুচি, জীবনাচরণ, সমাজনীতি, রাজনীতি প্রভৃতি চেতনার এক দীর্ঘ ঐতিহ্য থাকতে হয়। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মধ্যে সেই ম্যাচিউরিটি আছে কিনা তা তর্কসাপেক্ষ উত্তর, আরো দুই প্রজন্ম পরে হয়তোবা পরিস্থিতির কিছুটা উত্তরণ ঘটবে।

তাই শুধুমাত্র বাংলাদেশের কনটেক্সট এ ব্যবসাসফল, ব্যবসাহীন ট্যাগ দুটিকে উহ্য রাখাই সঙ্গত আপাতত।

শাহাদুজ্জামানকে আমি গুরুত্বপূর্ণ লেখক মনে করি। কেবল মনে করা নয়, দাবিও করি। অবশ্য বাংলাদেশে এস্টাব্লিশমেন্টের যে প্যারামিটার তাতে আমি দাবি না করলেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ লেখক, যেহেতু বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন (ব্র্যাকেটে এও বলে রাখি, বাংলাদেশের পুরস্কার ব্যবস্থার যে পদ্ধতিগত এবং অলিখিত শর্তগুলো রয়েছে সেগুলো নিয়ে অন্য অনেকের মতো আমারও প্রশ্ন রয়েছে)।

তবে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পাওয়ারও অন্তত ১ দশক আগে থেকে শাহাদুজ্জামানের লেখালিখিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। বরং পুরস্কার প্রাপ্তি পরবর্তী সময়ে তিনি আরেকজন সরকারী বুদ্ধিজীবী হিসেবে আবির্ভূত হন কিনা তা এক আকর্ষণীয় পর্যবেক্ষণ হতে পারে, যা একই সাথে কৌতুক এবং কৌতূহলোদ্দীপকও।

জীবিত এবং সক্রিয় যে কোনো সৃজনশীল মানুষকে নিয়ে লেখার ক্ষেত্রে বড়োরকম গোলযোগ আছে একটা; কাউকে নিয়ে লিখে ফেলা মানে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়া, তাকে একপ্রকারের মলাটবন্দী বানানো, পরবর্তীতে তার চিন্তা এবং পর্যবেক্ষণপ্রণালীর যে ভাঙন বা বিবর্তন সেগুলো উপলব্ধির বাইরে রয়ে যায়। অপরপক্ষে কেউ যদি অন্তত এক দশক তার সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে বিচরণ না করে তাকে নিয়ে লেখার ক্ষেত্রেও অতিমূল্যায়নের ঝুঁকি রয়ে যায়। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, নায়ক সালমান শাহ, ক্রিকেটার তালহা জুবায়ের প্রমুখ ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে লেখার সময় তাই কী করেছেন, তার চাইতে কী করতে পারতেন– সেইসব কল্পকথাই প্রাধান্য পায়।
শাহাদুজ্জামান প্রকাশিত লেখক, সময় হিসেবে তা দুই দশক পেরিয়েছে, তার একটা প্যাটার্ন বা সিগনেচার টোন তৈরি হয়ে গিয়েছে, যৌবনও অতিক্রম করেছেন, তবু কবীর চৌধুরী বা সরদার ফজলুল করিমের মতো যদি দীর্ঘায়ু লাভ করেন, লেখক হিসেবে তার আরও বহু বিবর্তিত হওয়া বাকি আছে সেক্ষেত্রে।

সুতরাং শাহাদুজ্জামানের লেখক সত্তার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তের চাইতে আপাত অনুসিদ্ধান্ত স্তরে উপনীত থেকেই লিখছি অনেকটা।

বাস্তব শাহাদুজ্জামানের চাইতে আধো বাস্তব আধো কাল্পনিক এক লেখকের প্রতিকৃতি আঁকার চেষ্টা করি।

আমার পর্যবেক্ষণানুসারে, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ পড়ুয়া মানুষ শাহাদুজ্জামানকে মূল্যায়ন করে গল্পকার হিসেবে।

ডকুফিকশন ক্রাচের কর্নেল সূত্রে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলেও পড়ুয়াদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মনে করেন এটা তার দুর্বলতম সৃষ্টি; কর্নেল তাহেরকে মহিমাণ্বিত করতে গিয়ে রাজনৈতিক চিন্তাদর্শের ক্ষেত্রে কিছু অতিশায়োক্তি করেছেন। কিংবা জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লেখা বায়োফিকশন ‘একজন কমলালেবু’ লেখক হিসেবে তার রিকগনিশনের ভিত্তি সবল করলেও, কথিত বোদ্ধাদের একটি অংশ এই বইকে সরাসরি ফাতরামি বলে তীর্যক মন্তব্য করেছেন, এবং জীবনান্দনুরাগী অনেকে বইটিকে সত্যের অপলাপ হিসেবে আখ্যায়িত করে অক্লান্ত কলম-মিসাইল ছুড়ে গেছেন।

তবে সুজনশীল মানুষের নিয়তিই হলো ঘেরাটোপে বাধা পড়া; একদল তীর্যক সমালোচনা করবে, আরেকদল অন্ধ ফ্যান এর আচরণ করবে; নির্মোহ বিশ্লেষণ তার ভাগ্যে জোটে কদাচিত। ‘নির্মোহ’ ধারণাটির নৃতাত্ত্বিক ভিত্তিই আমাদের জনপদে নাজুক।

তার অনুবাদকর্ম নিয়ে পাঠকদের একটি অংশ উচ্ছ্বসিত, তার সাক্ষাৎপ্রিয়তা, চলচ্চিত্রপ্রেম নিয়েও উচ্চধারণা পোষণ করেন বহু মানুষ। পত্রিকায় লেখা তার কলামগুলো নিয়েও অনলাইনে সমালোচনা চোখে পড়েছে। বিশেষত বামাদর্শ থেকে মধ্যপন্থা বা ডানপন্থার দিকে ঘেঁষবার এক প্রয়াস আবিষ্কার করে কেউ কেউ এটাকে তার স্খলন হিসেবে দেখেছে। তবে এগুলোকে সমালোচনা না বলে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বলাই সঙ্গত হবে। আমাদের দেশে বিদ্বেষ সংস্কৃতির ঐতিহাসিক ভিত্তি অত্যন্ত মজবুত।

কিন্তু ক্ষেত্রটা যখন ‘গল্প’, সেখানে শাহাদুজ্জামান তুলনামূলক নিরাপদ; অবিসংবাদীভাবে মূল্যায়ন না করলেও একেবারে ফেলে দেয়া হয় না, এবং পুরস্কারপ্রাপ্তির পর পড়ুয়াদের একটি অংশ সমকালীন অন্যতম প্রধান লেখক হিসেবে মূল্যায়ন করছেন।

শাহাদুজ্জামানের লেখা যখন প্রথম পড়েছিলাম, প্রথম উপলব্ধি ছিলো তিনি বাংলায় কেন লিখেন; তার ইংরেজিতে লেখা উচিত ইংরেজি ভাষায়, তিনি একজন বৈশ্বিক লেখক। বাংলা ভাষায় যাদের লেখা পড়ি গুটিকয় ব্যতিক্রম বাদে পায় প্রত্যেকেই বড্ড স্থানিক। লেখার প্লট, বর্ণনাভঙ্গি এবং পর্যবেক্ষণ গড়পড়তা ধরনের। শাহাদুজ্জামানের লেখা পড়বার পর অজান্তেই মুখ থেকে ‘স্মার্ট লেখক’ শব্দটি বেরিয়ে আসে।

বাংলাদেশে সাহিত্য পাঠ এবং আলোচনার যে ধারা এটা সনাতন এবং নীরস প্রকৃতির লাগে। পাঠক এবং লেখকেরা সমগ্র ব্যাপারটিকেই একটি কাঠামোতে আবদ্ধ করে ফেলেছেন, কোনো লেখার উৎকৃষ্টতা বা অসারতা নির্ণীত হচ্ছে সেই সনাতনী কাঠামোর সাপেক্ষে। মানুষের মেধা-মনন যে প্রতিনিয়ত পরিশীলিত আর পরিবর্ধিত হচ্ছে, মৌলিক এই ধারণাটির সাথেই বাংলাদেশী সাহিত্য সমাজ অভ্যস্ত হয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে।
শাহাদুজ্জামানের লেখা পড়ে তাই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলাম। এরকম এক্সপ্লোরিং প্রকৃতির একজন লেখককে গ্রহণের জন্য চিন্তার যে বৈচিত্র্য আর বৈপরীত্য থাকতে হয়, সেই সাহিত্যসমাজ কোথায়!

জীবনের এক পর্যায়ে অবশ্য আবিষ্কার করেছি ‘ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা’ একটি ব্যক্তিগত ফ্যান্টাসির চাইতে বেশি কিছু ছিলো না, উপরন্তু বাংলায় লেখালিখির কারণে যতটুকু সমাদর পান ইংরেজিতে লিখলে সেটুকু পাওয়াও দুরূহ হতো। সাহিত্য তো কেবল শিল্প নয়, ভূ-রাজনীতির সাথেও গভীর সম্পর্কযুক্ত উপকরণ।

শাহাদুজ্জামানের লেখাগুলো মূলত আইডিয়াভিত্তিক, তার চরিত্ররা মুখে কথা বলে কম, মাথায় ঘোরাঘুরি করে বেশি। সেই সাথে প্রতিবেশের অতি বর্ণনা দেয়ার যে চিরন্তন বাংলা গদ্যরীতি সেটাও তার লেখায় নিতান্ত গৌণ। তার বড়ো পরিসরের লেখা বা উপন্যাসগুলো যে মানুষকে কম টানে এর অন্যতম কারণ হতে পারে বর্ণনারীতিতে বাহুল্য এড়িয়ে চলা।

আইডিয়াভিত্তিক লেখালিখি পড়ুয়া প্রকৃতির মানুষদের ছোট্ট একটা অংশকে আকৃষ্ট করতো যদি না তিনি তার ভাষাভঙ্গিতে কাব্যিকতা রাখতেন। আমাদের পড়ুয়া সমাজে ভাষারীতি গুরুত্ব সর্বপ্রথমে; কী লিখছি এর চাইতে কীভাবে লিখছি এটা বিবেচনায় প্রাধান্য পায়, নইলে হয়তোবা শিল্পরুচিতে অনুত্তীর্ণ থেকে যায়।

আমি ব্যক্তিগতভাবে ভাষাভঙ্গিকে তেমন একটা মূল্যায়ন করি না, আমার কাছে চিন্তাভঙ্গিকে লেখার হৃৎপিণ্ড মনে হয়। শাহাদুজ্জামানের সুবিধা এখানেই যে, ভাষাভঙ্গি আর চিন্তাভঙ্গি দুই শ্রেণির পড়ুয়া মানুষের কাছেই তিনি পৌঁছুতে পেরেছেন। তবে সরল আর তরলের যে পার্থক্য সেই মানটুকু বজায় রাখেন বিধায়ই লাইন ধরে বই কেনার মতো পাঠকসংখ্যা তার হয়নি, এবং অনেকটা নিশ্চিন্তেই বলা যায়, কখনো হবেও না সেটা।

বাংলাদেশের আবহাওয়া-জলবায়ুতে বড়ো হওয়া শাহাদুজ্জামান চলমান ধারার বিপরীতে সাহিত্য রচনার সাহস কীভাবে পেলেন, তার চাইতে তার চিন্তাপ্রক্রিয়া এমন হলো কেন, সেই কৌতূহলটি আমাকে বেশিমাত্রায় তাড়িত করেছিল, ২০১২ তে সেই কৌতূহলের পারম্পর্যে তার এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণের সুযোগ ঘটেছিল। প্রথম প্রশ্নটিই ছিলো- ‘ধরা যাক আপনি এমন এক স্পেসে গেছেন যেখানে কেউ আপনাকে চেনে না, আপনাকে বলা হলো কে আপনি, কীভাবে নিজের পরিচয় দেবেন’।

নিজের পরিচয়ে তিনি একটি শব্দের আশ্রয় নিয়েছিলেন- ‘কৌতূহলী মানুষ’।

কৌতূহল শব্দটি অনেক সময়ই ভুলার্থে ব্যবহৃত হয়, কিংবা অনেকাংশে অতিমূল্যায়িতও। শাহাদুজ্জামানের জীবন পর্যালোচনা করলে কৌতূহলকে যথাযথই মনে হবে। আরো ৩৫-৩৬ বছর আগে মেডিকেলের ছাত্র সিনেমা নিয়ে মাতামাতি করবে, গান-বাজনা করতে চাইবে, এবং ডাক্তারি না করে পাবলিক হেলথ নিয়ে ক্যারিয়ার গড়বে, বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত সমাজের প্রেক্ষাপটে এটা অবশ্যই দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত এবং এজন্য পারিবারিক আর সামাজিক চাপ অনবরত যেভাবে পিষে ফেলতে চায়, কেবলমাত্র ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থাকা মানুষের পক্ষেই সেই স্ট্রাগলের তীব্রতা আর তীর্যকতা উপলব্ধি করা সম্ভব।

আমি অবশ্য তার ট্র্যাক চেঞ্জকে কৌতূহলী মানুষ হওয়ার ক্ষেত্রে খুব বড়ো কারণ হিসেবে গণ্য করি না। পড়াশোনা আর ক্যারিয়ার সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার, সময়ের অনিবার্যতায় অনেকেরই ট্র্যাক বদলে যায় বা অতীতে গিয়েছে, তাতে কি তারাও কৌতূহলী মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পাবে?

শাহাদুজ্জামানের ক্ষেত্রে স্পার্কিং ফ্যাক্টর হতে পারে শৈশব আর কৈশোরেই বৈশ্বিকতার সাথে মানসিকভাবে সংযুক্ত হওয়া এবং সেটা ধরে রাখা। ২০১২ এর সেই সাক্ষাৎকারসূত্রে জেনেছিলাম, তাদের বাড়িতে বড়ো লাইব্রেরি ছিলো, তার বাবা প্রচুর বই পড়তেন, এবং তখন থেকেই বিশ্বসাহিত্যের অনেক লেখকের সাথেই তার পরিচয় গড়ে উঠেছিলো, পরবর্তীতে যখন বাড়ি ছেড়ে মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন পড়াশোনার সেই অভ্যাসটা জারি ছিলো।

জীবনের প্রথম ১৪-১৫ বছরের মধ্যেই মানুষের ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠে, ক্রমাণ্বয়ে তা পরিপক্বতা পায়। শৈশব-কৈশোরের বিপুল পড়ুয়া বহু মানুষই পরিণত বয়সে জীবন-জীবিকার ঘূর্ণিপাকে পাঠের সাথে সংস্রবহীন জীবন কাটায়, শাহাদুজ্জামানের ক্ষেত্রে তা ঘটেনি এর অন্যতম কারণ হতে পারে, আমার অনুমান, তিনি জীবনে কিছু হতে চাননি বা একজন পরিব্রাজক হতে চেয়েছিলেন। একজন মানুষ যখন জীবনে কিছুই হতে চাই না, কেবল দেখতে আর শুনতে চাই- ব্রত নেয়ার সাহস রাখতে পারে, চাইলেও সে পুরোদস্তুর জৈবিক মানুষ হয়ে উঠতে পারে না, তার জীবন কেটে যায় সেলফিশনেসে, কিন্তু সেলফিশ ফর আ গ্রেটার রিজন।

‘গ্রেটার রিজন’ শব্দটা অবশ্য অতি মহিমাণ্বিত। একজন শাহাদুজ্জামান যদি জীবনে কিছুই হতে চাই না ব্রত নিয়ে কেবল নিজস্ব পর্যবেক্ষণ আর কৌতূহল নিবৃত্তিতেই সময় অতিবাহিত করে, সেই আত্মকেন্দ্রিকতায় জগতের কার কী এসে যায়; একে গ্রেটার রিজন বলে দায়মুক্তির আয়োজন কেন, এবং যারা টুকটাক সৃজনশীলতার সাথে জড়িত প্রত্যেকেই কি আউটসাইডার বা আগন্তুক সত্তায় বিশেষায়িত হবে, এবং গ্রেটার রিজন নামক ঢাল দিয়ে তাদের আড়াল করা হবে?

একারণে গ্রেটার রিজনকে আমি সংজ্ঞায়িত করি, যেখানে মিনিং আর পারপাস আছে যা বস্তুবাদীতার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়। এটা ভালো নাকি মন্দ সেই তর্ক অমূলক, যার যার কমফোর্টের উপর নির্ভর করে।

শাহাদুজ্জামানের সাথে অন্যান্য বাংলাদেশী লেখকের পার্থক্য কী?

বিশেষত বাংলাদেশী ছোটগল্পে শহীদুল জহিরের সাথে তার নামটিও উচ্চারিত হয়। শহীদুল জহিরের গল্প-উপন্যাসের সংখ্যা খুব বেশি নয়, বাজারে পাওয়া যায় এমন সব বই-ই পড়েছি সম্ভবত। শহীদুল জহিরের ভাষাভঙ্গি আর বর্ণনারীতি ম্যাজিক রিয়েলিজমের মতো লাগে, যেন তার পেটেন্ট করা। তবে সমস্যা হলো, কয়েকটা লেখা পড়ার পরই তার এই ভাষারীতিকে আরোপিত এবং একঘেয়ে মনে হতে থাকে, এবং তার গল্পের প্লটগুলোও রিয়েলিস্ট ঘরানার, যা পড়তে গিয়ে খুব একটা উচ্ছ্বাস কাজ করে না।

পক্ষান্তরে শাহাদুজ্জামানের ভাষাভঙ্গি নিয়ত বিবর্তিত হয়েছে, একঘেয়িমিতা আসেনি, এবং ফর্ম আর প্লট নিয়ে প্রচুর নিরীক্ষণ করেছেন। তিনি গবেষক নন, ফিকশন লেখক; তাই রক্ত-মাংসের ব্যক্তিচরিত্রকে বড়ো ক্যানভাসে ধারণ করতে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে নিজস্ব ভাবনা বা কল্পনাশীলতার আশ্রয় নেন, যা বাঙালি বোদ্ধামহলে জাত গেল অনুভূতির সঞ্চার করে। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে এই ইমপ্রোভাইজেশনগুলো পছন্দ করি। তিনি তো কর্নেল তাহের বা জীবনানন্দের জীবনি লিখতে বসেননি, তাদের চিন্তাপ্রক্রিয়াকে কতটা আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরতে পারছেন সেটাই মূখ্য আমার কাছে। চিন্তাপ্রক্রিয়ার চাইতে তথ্য-উপাত্তের চাহিদা বেশি হওয়ায় এদেশে কোনোকিছুতেই রিমার্কেবল কিছু করার স্কোপ অনেক বেশি সংকীর্ণ।

যদিও সাহিত্য আলোচনা, তবু পার্থক্য বোঝার জন্য ক্রিকেটকেও এখানে যুক্ত করতে হচ্ছে। সাকিব, মুশফিক দুজনই ভালো ক্রিকেটার, তবু সাকিবের যে মানসিক গঠন তার সাথে কোনো বাঙালি ক্রিকেটারের মিলে না কেন, এবং প্রতিনিয়ত সমালোচিত হয়েও মুশফিক উইকেট কিপিং ছাড়ে না, কিছু হলেই কান্নাকাটি করে, কেন এমনটা হয়? মুশফিক চ্যালেঞ্জকে ভয় পায়, সাকিব চ্যালেঞ্জ না থাকলে কিক পায় না।
শাহাদুজ্জামানের উৎকর্ষের মূল উৎসই তাই চ্যালেঞ্জপ্রিয়তা মনে হয় আমার।
তিনি ফিডেল ক্যাস্ট্রো বা চার্লি চ্যাপলিনকে নিয়ে যেভাবে লিখেছেন এই আদলে চিন্তা করতে পারাটাও এক বিশাল যোগ্যতা।

শাহাদুজ্জামানের লেখা আমার এখনো মনোমুগ্ধকর লাগে, এখনো তার লেখায় নিরীক্ষাধর্মীতা খুঁজে পাই, ফলে আমার বয়স বাড়লেও শাহাদুজ্জামানের চিন্তাপৃথিবী একই রকম রয়ে গেছে তারুণ্যের এডভেঞ্চারপ্রিয়তা বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।