‘জামরুল গাছে ইমরুল ঝুলে, ভীমরুলে নিছে পরচুলা খুলে’- লাইন দুটো লেখার পরই ব্যাকস্পেস চেপে মুছে দিতে চেয়েছিলাম। অনলাইনবাসীর সেন্স অব হিউমারের প্রতি ততোটাই আস্থা আমার যতটা আস্থা রাখা উচিত গ্লেন ম্যাকগ্রাথের ব্যাটিং সামর্থ্যে।
তবু বারবার হিউমারই চলে আসছে ইমরুল কায়েস সংক্রান্ত লেখায়। সাধারণত নিজেকে নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টাই করি না, যা ইচ্ছা, সেটা গর্হিত বা প্রশংসিত যেমনই হোক, করার ক্ষেত্রে ২য় বার ভাবি না। যেমন, ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের ১৪ই অক্টোবর এক সুন্দর মনোরমা-মনোহরী দিনে চট্টলার মাটিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষিক্ত হয়েছিলেন বাংলার সর্বাধিক আলোচিত ক্রিকেটার জনাব ইমরুল কায়েস সাগর- এই লাইনটা লিখবো না সংকল্প নিয়েও রাখতে পারলাম না। সাকিব বা মাশরাফিকে নিয়ে যতো আলোচনা হয়, ইমরুলের জন্য বরাদ্দ আলোচনা তার ১.৭ গুণ বেশি। একদল তাকে ট্রল করে, একদল তার প্রতি সহমর্মিতা বোধ করে ট্রলকারীদের সাথে পরিসংখ্যানযুদ্ধে নামে, সম্প্রতি শেষ হওয়া জিম্বাবুইয়ে সিরিজের পর সহমর্মিদের অন্তত ৩% মানুষ তার ফ্যান হয়ে তার গুণকীর্তন করবেন এবং আমার মতো গুটিকয় মানুষ আছেন যারা ক্যারিয়ারের প্রথম থেকেই ইমরুল কায়েস ঘরানার ব্যাটসম্যানদের বাংলাদেশ ওয়ানডে দলে অপাঙক্তেয় মনে করি, করে যাবো- তারা অনলাইনবাসীর কাছ থেকে ‘খবিশ, খাটাশ, খানকির পোলা’ জাতীয় বিশেষণ পেয়ে অভিভূত হয়ে ‘কেন ইমরুল অপাঙক্তেয়’ সেই সংক্রান্ত দীর্ঘ নিবন্ধ লিখতে শুরু করবো।
বাংলাদেশের আর কোন্ ক্রিকেটার আছেন যিনি সকল শ্রেণির ক্রিকেট দর্শকের কাছ থেকে শব্দ আদায় করতে পেরেছেন? কিংবা টেস্ট ক্রিকেটে অকেশনাল উইকেট কিপার হিসেবে ৫টা ডিসমিসালের বিশ্বরেকর্ডধারী ক্রিকেটারই বা কে ছিলেন কবে? কিংবা প্রয়াত মানজারুল ইসলাম রানার পর তিনিই একমাত্র বাংলাদেশী ক্রিকেটার যিনি পরপর ২ ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হয়েছেন, তাও ২০১১ বিশ্বকাপের বড়ো আসরে! বাংলাদেশের ক্রিকেট লেখালিখি তাই ইমরুলময় মহাশয়!
আমার স্টার্ট আপ হিউম্যানল্যাব৭৭৭ এর ওয়েবসাইট কনটেন্ট লেখার কাজ ১ মাসের বেশি হলো পিছিয়ে আছে, যতো দ্রুত ওয়েবসাইট দৃশ্যমান করবো, নিজের সারভাইভ করার সম্ভাবনা বাড়বে ততো, তবু অস্তত্বি সংকটকে উপেক্ষা করে ক্রমাগত নিবন্ধ লেখালিখিতেই সময় চলে যাচ্ছে। কী লাভ এতে? ইমরুল কায়েস রান করছে, স্মার্ট কিছু দর্শক যারা ম্যাচের হাইলাইটস অথবা ক্রিকইনফোতে স্কোরকার্ড দেখে তাকে দলে দেখতে চায়, তার বাববার ফিরে আসার স্পিরিট দেখে নিজেরা উজ্জীবিত হয়, হোক না; আমি জীবিকাজীবীতায় সময় দিই। ইমরুল হেন, ইমরুল তেন- এইসব টিনএজারের বৈশিষ্ট্য চর্চা কি শোভা পায় আমার, বিশেষত ক্রিকেট বিষয়েই যেহেতু আরো লেখার আছে। এই নিবন্ধ পড়ে কিছু মানুষ সহমত হবে, কিছু মানুষ ক্ষিপ্ত হবে- সবই তো নিছক ডাটা; কেন ইমরুল কায়েসকে নিয়ে পড়ে থাকতে হবে! এটা কি ইগো স্যাটিসফাইংয়ের প্রবল নেশা; এতো তত্ত্বকথা লিখে শেষ পর্যন্ত ইগো ম্যানিয়াকের ঊর্ধ্বে উঠতে পারলাম কই! ছিঃ, আমি আসলেই একটা রদ্দি মাল!
নিবন্ধের ৪ প্যারা পড়ে যেমন নড়বড়ে মনে হচ্ছে, এটাই ইমরুল কায়েসের আন্তর্জাতিক ব্যাটিং প্যাটার্ন। যেহেতু তাকে নিয়ে লিখছি, লেখার ধরনেও তার ব্যাটিংকে রিফ্লেক্ট করা উচিত।
ইমরুল কায়েসের ট্রলকারীদের বক্তব্যের সারমর্ম- ডিপ স্কয়ার লেগে একজন মাত্র ফিল্ডার রেখে শর্ট বল করলেও কায়েস সেই বলেই আউট হবেন; তার হাতে মাখন মাখানো; যেখানেই ফিল্ডিং করুন বল তাকে খুঁজে নিবেই এবং ক্যাচও পড়বে তার হাত থেকে। তার ফিটনেস লেভেল অত্যন্ত বাজে, ঘাম হয় প্রচুর যে কারণে ৫৯(আমি মৌলিক সংখ্যা ব্যতীত অন্য কোনো সংখ্যা লিখলে মাথায় প্রচণ্ড প্রেসার পড়ে, পাঠক কোনো একটা রাউন্ড ফিগার বুঝে নিয়েন) পেরুলেই তার ক্র্যাম্প হয়। তিনি যতক্ষণই ব্যাট করুন, সবসময়ই শেকি বা নড়বড়ে লাগে।
ইমরুলের সহমর্মীদের বক্তব্যের সারমর্ম- ইমরুলকে নিয়ে সমালোচনা করা হয় কারণ তার খেলায় গ্ল্যামার নেই, তিনি প্রতিভাবান নন, তিনি তথাকথিত স্টাইলিস ব্যাটসম্যানদের মতো ফ্যান্সি শট খেলতে পারেন না। কিন্তু দিনের পর দিন নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে পরিশ্রম করেছেন, দমে যান নি বা হাল ছেড়ে দেননি। যখনই সুযোগ পেয়েছেন রান করেছেন নিজেকে উজাড় করে দিয়ে। ২০১০ এ ৮৬৭ রান করে সেবছর বিশ্বক্রিকেটেই ৫ম সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হয়েছিলেন। এমনকি নিউজিল্যান্ড সফরে মুশফিক ইনজুরিতে পড়লে প্রক্সি কিপার হিসেবে ১৫০ ওভার উইকেট কিপিং করেছেন; এতেই দলের/দেশের প্রতি তার নিবেদন বোঝা যায়। তামিমের সাথে দারুণ সঙ্গত দেয়া সত্ত্বেও বারবার তাকে উপেক্ষা করা হয়েছে। চন্দরপালের মতো কুৎসিত টেকনিকের ব্যাটসম্যান ওয়েস্ট ইন্ডিজে কিংবদন্তী হয়, আর আমাদের দেশের আবাল ক্রিকেট বোদ্ধারা কখনো শামসুর রহমান, কখনো নাজিম উদ্দিন- এনামুল বিজয়, কখনোবা সৌম্য-লিটনের প্রেমে পড়ে তাকে চক্ষুশূল বানিয়েছে। অথচ বোর্ড যদি তার প্রতি পর্যাপ্ত যত্নবান হতো, এতোদিনে সে হয়তোবা বিবেচিত হতো আমাদের ক্রিকেটের ৬ষ্ঠ পাণ্ডব হিসেবে!
জিম্বাবুইয়ে সিরিজের পর তার খেলায় বিমুগ্ধ দর্শকদের বক্তব্যের সারমর্ম- এশিয়া কাপ থেকেই ইমরুলের খেলায় ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই ইমরুল পরিণত, ডট খেলে কম, ক্লিন হিট করতে পারে, দলের বিপর্যয়ে সাইফুদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে জানে। তার ফিটনেসেরও অভূতপূর্ব উন্নতি লক্ষ্য করছি। নিজেকে সে ভেঙ্গেচুরে নতুন করে গড়েছে। বিশ্বকাপে তামিমের ওপেনিং পার্টনার হিসেবে সে-ই যোগ্যতম। ১ ম্যাচে রান করে ৩ ম্যাচ ডাব্বা মারা প্রতিভার ডিব্বার চাইতে প্রতি ম্যাচেই কিছু কিছু রান করা ব্যাটসম্যানই বেশি দরকার আমাদের। রান করাটাই শেষ কথা, কীভাবে তা এলো এটা ধর্তব্যই নয়।
তিনপক্ষের বক্তব্যই উপস্থাপন করলাম। যেহেতু অনেকদিন ধরেই ইমরুলকে পর্যবেক্ষণ করছি তাকে ঘিরে পাওয়া মন্তব্যগুলোতে চোখ রাখাও এ পথের গুরুত্বপূর্ণ তরিকা।
তন্মধ্য প্রথম পক্ষ এক্সট্রিমিস্ট, ৩য় পক্ষ তাসের ঘর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন; ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ আর নিউজিল্যান্ড সফরে ইমরুল ব্যর্থ হলেই তারা হয় ১ম অথবা ২য় পক্ষে যোগদান করবে; এদের নিজস্ব কোনো আদর্শ নেই আদতে। কেবলমাত্র ইমরুল নয়, যে কোনো খেলোয়াড়ের ক্ষেত্রেই এই পক্ষের আচরণ অভিন্ন।
২য় পক্ষের বক্তব্যগুলোকে ভ্যালিড মনে হয়। চাইলেই আপনি একে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। পরিসংখ্যান ইমরুলকে কোনোভাবেই ফেলে দেয়ার কাতারে রাখতে দেবে না। এটা নিয়ে আমি ২০১৬-১৭ তে ভেবেছিও। তখন বরং পাল্টা প্রশ্ন করেছি এভাবে- ইমরুলের পারফরম্যান্স ফেলনাযোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও বোর্ড কেন ইমরুলের ওপর আস্থা রাখতে পারে না? প্রত্যেক কোচেরই পছন্দের কয়েকজন খেলোয়াড় থাকে দলে। ইমরুল দলে ঢোকার পর কোচ হিসেবে এসেছেন জেমি সিডন্স, স্টুয়ার্ট ল, শেন জার্গেনসন, হাথুরুসিংহে, স্টিভ রোডস। কোনো কোচের গুডবুকেই ইমরুলের নাম থাকার গল্প শোনা যায় না কেন? অন্যরা সুযোগ পেয়েও বারবার ব্যর্থ হচ্ছে, তবু ইমরুলের প্রতি আস্থা কেন নেই। এই একটা প্রশ্ন খুবই জটিল লাগে, যার উত্তর মেলাতে পারি না। তখন আমি ওপেনারের তালিকাগুলো পরীক্ষা করি- জুনায়েদ সিদ্দিকী, জহুরুল ইসলাম, নাজিম উদ্দিন, শামসুর রহমান, এনামুল হক বিজয়, সৌম্য সরকার, লিটন দাস। আশরাফুল কিছু ম্যাচ ওপেন করেছে, শাহরিয়ার নাফিস ফেরত এসেছিলো মাঝে একবার- কিন্তু তারা যেহেতু পুরনো প্লেয়ার, লিস্টে তাদের আমলে নিচ্ছি না।
নামগুলো খেয়াল করলে তাদের মধ্যে কোরিলেশন পাওয়া যায়। এরা প্রত্যেকেই স্ট্রোক প্লেয়ার। জুনায়েদ সিদ্দিকী ২০০৭ টি২০ বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুরন্ত হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন, জহুরুল ইসলামও স্ট্রোক খেলতেন, নাজিম উদ্দিন প্র্যাকটিস ম্যাচে শোয়েব আখতারকেও ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন, শামসুর রহমান নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৩০০ চেজ করে ম্যাচ জিতিয়েছেন, এনামুল বিজয় প্রচুর ডট খেললেও তিনি চালিয়ে খেলতে পছন্দ করেন। সৌম্য আর লিটনের ব্যাটিং এপ্রোচও আক্রমণাত্মক।
তবে কি ইমরুল স্ট্রোক প্লেয়ার নয় বলেই ওপেনিংয়ে আস্থা অর্জন করতে পারেননি? কিন্তু তখন তো তামিমকে ফ্রি লাইসেন্স দেয়া ছিলো (কোচ জেমি সিডন্সের আমলে), চালিয়ে খেলতেন তিনি; আরেকজন ব্যাটসম্যানকেও এগ্রেসিভ হতে হবে নাকি; বাংলাদেশ কি তবে হেইডেন-গিলক্রিস্ট জুটি চাইছিলো? আমার কখনোই তা মনে হয়নি।
ক্রিকেট খেলায় ১১ জন খেলোয়াড় খেলে ১১রকম রোলে। কারো দায়িত্ব থাকে রানরেট বাড়ানো, কারো দায়িত্ব ইনিংসের ফ্লো ধরে রাখা, কারো শিপ এনকরিং, কারো ক্যামিও, কিংবা বোলিংয়ে কেউ উইকেট টেকিং, কেউ রান নিয়ন্ত্রণ রাখা,কেউ ব্যাটসম্যানকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মধ্যে রাখা। ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী রোল অনেক সময় পরিবর্তন করতে হয়, একারণে গিয়ার সুইচিং এবিলিটি বা সুন্দর বাংলায় অভিযোজন ক্ষমতা পূর্বশর্ত। ইমরুলকে পর্যালোচনা করে সবসময়ই মনে হয়েছে, তাকে কোনো রোলে ফিট করতে পারছে না টিম ম্যানেজমেন্ট; তাকে খেলায় কেবলমাত্র ভালো বিকল্প অপশন না থাকায়। যখনই কাউকে প্রতিশ্রুতিশীল মনে হয়েছে টিম ম্যানেজমেন্ট তাকে পরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছে। কেউ একজনও যদি ধারাবাহিক হতো, ইমরুল কায়েসের নামের পাশেও শামসুর রহমান, জুনায়েদ ইমরোজের মতো প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেটার ট্যাগ জুড়ে যেতো।
এই যে বোর্ড বা টিম ম্যানেজমেন্ট তাকে কোনো রোলে ফিট করতে পারছে না, এটা নিশ্চয়ই ইমরুলও অনুভব করতেন। আপনি যখন বুঝতে পারবেন আপনি যতটা নিজের যোগ্যতায় টিকে আছেন, তার চাইতে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে অন্যদের অযোগ্যতা- আপনার মধ্যে ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্স চলে আসবেই। আপনি ইনসিকিউরিটিতে ভুগবেন। ইনসিকিউরিটি ফিলিং কোনো অংশেই বিলুপ্তিচিন্তার চাইতে কম ভয়ানক নয়। তার প্রভাব আমরা দেখি ২০১১ বিশ্বকাপ পরবর্তী ইমরুলের ব্যাটিংয়ে; তিনি যতটা নড়বড়ে ছিলেন শুরুতে, আরো বেশি নড়বড়ে হয়ে পড়েন।
কিন্তু ইমরুল যে রানগুলো করেছে সেগুলো তো দলের স্কোরেই যুক্ত হয়েছে; তবু তাকে কোনো রোলে ফিট করতে না পারার যুক্তিটা কেমন হাস্যকর শোনায় না?
সীমিত ওভারের ক্রিকেটের প্রধান চালিকাশক্তি যে কোনো দলের প্রথম ৩ ব্যাটসম্যান বা টপ অর্ডারের কন্ট্রিবিউশন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্বর্ণযুগ, সর্বজয়ী অস্ট্রেলিয়া, ৯৬ বিশ্বকাপের শ্রীলংকা, এমনকি হাল আমলের ভারত-ইংল্যান্ডের ব্যাটিং পর্যালোচনা করে দেখুন; টপ থ্রি এর একজন সেখানে পাওয়ার হাউসের দায়িত্ব নিয়ে নেন, পরের দিকের ব্যাটসম্যানরা কেবল সেই পরম্পরাটা ধরে রাখে। বাংলাদেশের ব্যাটিং মিডল অর্ডার নির্ভর, সেটা পাইলটদের যুগেও ছিলো, এখন নিয়মিত জিতলেও ঐতিহ্যতে পরিবর্তন আসেনি।
কিন্তু মিডল অর্ডারের উপর নির্ভরশীলতা ডিফেন্সিভ স্ট্র্যাটেজি। আগে ব্যাট করতে নেমে শুরুতেই ২-৩ উইকেট হারিয়ে ফেললে বড়ো রান করা মুশকিল হয়ে পড়ে, মিডল অর্ডার তখন ব্যতিব্যস্ত থাকে ধ্বস সামলে ফাইটিং টোটাল দাঁড় করাতে। অন্যদিকে চেজ করতে গিয়ে এই ঘটনা ঘটলে মিডল অর্ডার চাপে পড়ে যায় রান রেটের প্রেসার ঠিক রাখতে। বাংলাদেশের স্কোর তাই ২৪১-২৬৩ এর মধ্যেই ঘোরাফেরা করে, এবং বোলিংয়ে বোলাররা আর্লি ব্রেক থ্রু এনে ফাইট করে; ম্যাচ নিষ্পত্তি হয় একেবারে শেষ ওভারে গিয়ে। এমেচার দাবা খেলোয়াড়রা এভাবে খেলে; সব পিস শেষ, যার ১-২ টা সৈন্য বেশি থাকে সে-ই রাজা দিয়ে সৈন্যকে গার্ড করে সৈন্যকে মন্ত্রী বানায়।
কিন্তু টি২০ এর প্রাদুর্ভাবে ওয়ানডে ক্রিকেটের ব্যাকরণ অনেকাংশে বদলে গেছে। মিডল অর্ডার নির্ভরতার স্ট্র্যাটেজি বড়ো টুর্নামেন্টগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বুমেরাং হয়, এবং এই দলগুলো আনপ্রেডিক্টেবল, চোকার্স প্রভৃতি তকমা পেয়ে যায়।
তাহলে তো বাংলাদেশের জন্য ইমরুলই শ্রেষ্ঠ ওপেনার; সে যেভাবেই হোক সারভাইভ করবে, শুরুতে উইকেট পড়বে না। পাওয়ার প্লে-তে উইকেট না হারিয়ে তারপর রান করা যাবে; কিন্তু আপনাকে তো পাওয়ার প্লে এর এডভান্টেজও নিতে হবে। কায়েস কি সেটা পারতো না? চেষ্টা করলে কেন পারবে না; তাহলে গ্যাপটা কোথায়?
ক্রিকেট খেলাটা রিদম, রিফ্লেক্স আর সেলফ-বিলিফ নির্ভর। টিম গেম যতগুলো প্রচলিত আছে, আমার ধারণা ক্রিকেটই দুর্বোধ্যতম এবং ঝুঁকিপূর্ণ, সেই সাথে প্রচণ্ডরকম মনস্তাত্ত্বিক; ক্রিকেটের অজনপ্রিয় হওয়ার ক্ষেত্রে এগুলো গুরুতর কারণ, সময়ব্যাপীতা ২য় স্তরের কারণ হতে পারে। দেখতে যতোই সহজ লাগুক, মাত্র ২২ গজ দূরত্ব থেকে প্রায় আড়াই আউন্সের একটা গোলা ছুড়ে দেয়া হচ্ছে; আপনার ২ পায়ে প্যাড, মাথায় হেলমেট, হাতে গ্লাভস, প্রায় ২-২.৫ কেজি ওজনের ব্যাট; এই অবস্থায় বল পিচে পড়ামাত্র আপনার কাছে চলে আসবে, মিলি-মাইক্রোসেকেন্ডের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে কী করবেন- ডিফেন্স, নাকি আলতো পুশ, নাকি শট। খেললে কোন্ শট। বোলারের হাতের অবস্থান দেখেও অনেক সময় অনুমান করে নিতে হয়।
ধরা যাক, আপনি একজন এগ্রেসিভ ওপেনার। আপনার সাথে যিনি ওপেন করতে নেমেছেন তিনি প্রায় বলে বলে বিট হচ্ছেন, এটা আপনার কনফিডেন্সকে নাড়া দিবে; বিপক্ষ দলকে রিদমে ফিরতে সহায়তা করবে, ম্যাচের মোমেন্টাম নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিবে তারা। একজন বোলারকে ড্রাইভ করে চার মারুন, কিংবা হুক করে ছক্কা মেরে দিন কিংবা সলিড ডিফেন্স করুন, প্রতিক্ষেত্রেই বোলারের রিদম এলোমেলো হবে। পক্ষান্তরে আপনি ইনসাইড এজ এ চার মেরেছেন, টপ এজড ছক্কা হয়ে গেছে- এসব ক্ষেত্রে বোলারের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করবেন এরপর; আপনি রান করছেন বটে, কিন্তু এগুলো বোলারের কনফিডেন্স বাড়িয়ে দেয়, তার রিদম চলে আসতে শুরু করবে, কোয়ালিটি ডেলিভার দেবার সম্ভাবনা বাড়বে। আপনি তার সুইংয়ে বিট হয়ে প্যাডে বল লাগিয়েছেন, ক্লোজ ইন ফিল্ডার-কিপার-বোলার সমস্বরে আবেদন করবে, আপনার কনফিডেন্স নড়েচড়ে উঠবে; আপনার রিদম কমতে শুরু করবে। কিন্তু আপনি শট খেলতে গিয়ে লাইন মিস করেছেন, এটা আপনার টেকনিকাল দুর্বলতা কিংবা আপনি নিশ্চিত বল লেগস্ট্যাম্পের বাইরে পিচ করেছে, এই প্যাডে লাগা আপনি কেয়ারই করবেন না। ফলে আপনি যখন ব্যাট করছেন সেটা শুধু একা আপনার রেসপনসিবিলিটি নয়, আপনার পার্টনার এবং পরে যিনি নামবেন তার মনস্তত্ত্বেও গভীর প্রভাব ফেলে। একারণেই দলের টপ অর্ডার এবং ওপেনিং বোলারের গুরুত্ব এতো বেশি। আপনার পার্টনারকে বিট হতে দেখলে আপনিও মিস টাইম করে ফেলবেন যে কোনো সময়। মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা তুলনামূলক কম হয়, কারণ ততক্ষণে ম্যাচের ইনিশিয়াল মোমেন্টাম কোনো একদিকে চলে গেছে; আপনাকে হয় মোমেন্টাম পুনরুদ্ধার করতে হবে অথবা ধরে রাখতে হবে।
আমরা সাধারণ ক্রিকেট দর্শকরা কোচ, অধিনায়ক এবং নির্বাচকদের যতোই গালি দিই, মাঠের ক্রিকেটটা তারা বোঝার চেষ্টা করেন, নইলে খামোখা একজন কোচকে ১৭-২০ লাখ টাকা বেতন দেয়া হয় না। টাকা নারিকেল গাছে ধরে না।— এই অনুসিদ্ধান্তে যখন উপনীত হই, তারপর ইমরুল কায়েসের ব্যাটিং ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে শুরু করি, এবং বুঝতে পারি কেন কোচের পর কোচ গেলেও ইমরুলের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় না, কেন রান করা সত্ত্বেও তার প্রতি আস্থা রাখতে পারে না। তিনি যদি ৫বা ৬ নম্বরে ব্যাটিং করতেন, হয়তোবা তাকে নিয়ে তেমন কোনো কথাই হতো না। রান করছেন সেটাই যথেষ্ট। যেমন, মোহাম্মদ মিথুনের ব্যাটিং স্টাইল মোটেই কনভিন্সিং নয়, তবু সে উতরে যাচ্ছে যেহেতু তাকে ব্যাট করতে হবে ৫-৬-৭ এর মতো পজিশনে ব্যাট করতে হয়। ওয়ানডেতে ওপেন করাটাই কি ইমরুলের ক্যারিয়ারের ভুলতম সিদ্ধান্ত? কিন্তু ওপেন না করলে তিনি খেলতেনই বা কোথায়। তাছাড়া ওপেনে রানও তো পাচ্ছেন; তবু তিনি ব্রাত্য কেন?
আমি স্টাইলিশ ব্যাটসম্যানদের পছন্দ করি, সেটা আমার ব্যক্তিগত প্রেফারেন্স। কিন্তু যখন আমি কাউকে মূল্যায়ন করি তখন নির্মোহ থাকার চেষ্টা করি। নির্মোহ আর নিরপেক্ষ সমার্থক নয়। কারো প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট আমি থাকতেই পারি, কিন্তু সেটা যেন তার যোগ্যতাকে ছাপিয়ে বড়ো কারণ কখনোই না হয়ে উঠে- এই চর্চা অন্যরকম গ্রুপে ৯ বছর ক্রিয়েটিভ কনসালটেন্টট থাকাকালে এতো কঠোরভাবে চালিয়ে গিয়েছি যে, এখন আর চাইলেও নির্মোহতা এড়াতে পারি না মূল্যায়নের ক্ষেত্রে।
স্টাইলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব থাকলেও ইমরুল কায়েসকে বিরক্ত লাগার ক্ষেত্রে সেটা কারণ হয়ে উঠেনি। একজন ওপেনিং ব্যাটসম্যান প্রায় প্রতি বলে এভাবে বিট হবে কেন, এটা কিছুতেই মানতে পারতাম না। এমনকি সামহোয়ারইন ব্লগে ২০০৯ এর দিকে যখন হাইফেন নিকে ব্লগিং করতাম তখন তার নাম বিকৃত করে ‘ভীমরুল পায়েস’ রেখে দিয়েছিলাম, যেটা তৎকালে ব্লগ পরিমণ্ডলে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো। যদিও নামবিকৃতি গর্হিত অপরাধ, ১০ বছর আগে ডার্ক হিউমার, ননসেন্স হিউমার, প্যারোডি, রম্যতে এতো বেশি অবসেসড ছিলাম, অপরাধকে তখন নিছক ফান বা কমেডি গণ্য করেছিলাম। আজ এতো বছর বাদে ২২ বছরের সেই তরুণের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
ক্রিকেট খেলাটাকে প্রচণ্ড ম্যানলি লাগে আমার; পেস বোলার দৌড়ে এসে নতুন বল ছুড়ে দিচ্ছে, সিম পিচে হিট করে ব্যাটসম্যানের কাছে যাচ্ছে, সে সেটা ড্রাইভ করে তাকে চ্যালেঞ্জ জানাবে- এখানেই তো পৌরুষ; কিংবা ব্যাটসম্যান সুইং আর গতিতে পরাস্ত হয়ে ক্লিন বোল্ড হবে। একারণেই ওয়াকার ইউনিস আর ব্রেট লির বোলিং এতোখানি উত্তেজনা সহকারে দেখতাম। কিন্তু ইমরুল কায়েস যেভাবে বিট হতো, মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতাম না; মনে হতো স্কুল ক্রিকেটার পাঠানো হয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। ঠিক একই কারণে জাভেদ ওমর, হান্নান সরকার জাতীয় ওপেনারদের দেখলে জঘন্য লাগতো। ওপেনিং ব্যাটসম্যান আউট হতেই পারে, কিন্তু বিট হবে কেন? তামিম ইকবাল অন্তত ৫-৭ ম্যাচে ম্যাচের প্রথম বলেই বোল্ড বা স্ট্যাম্পিং হয়েছে, তবু তার আউট হওয়া দেখে একটুও হতাশ লাগেনি; বোলারও তো উইকেট নিতেই এসেছে আন্তর্জাতিক আঙিনায়, তার দেশের শত শত বোলারকে পেছনে ফেলে সে যেহেতু এই পর্যায়ে খেলেছে, যোগ্যতায় তো সেও ভরপুর।
ইমরুলের এই বিট হওয়া যখন তাকে চরম অপছন্দের তালিকায় নিয়ে যায়, তারও দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমার জানা ছিলো না তিনি কেন বারবার ফেরত আসেন। আমিও নির্বাচকদের উপর চটে যাই ভীষণ। কিন্তু দিন আগায়, পর্যবেক্ষণের আরো গভীর স্তরে প্রবেশ করতে থাকি মানুষ সংক্রান্ত গবেষণায়। মানুষের ইন্টারভিউ নেয়ার সংখ্যা বাড়িয়ে দিই। মেন্টাল টাফনেস, ব্যক্তিসত্তা সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন তূন সংযুক্ত হতে শুরু করে।
যেহেতু ক্রিকেট দেখা শুরু করলে একটি বলও মিস দিই না, ফলে ম্যাচের প্রতিটি মুহূর্ত সম্বন্ধে আমার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ তৈরি হয়। সেগুলো সবসময় যৌক্তিক হয় তা বলবো না, অনেক কিছুই হাইপোথিসিস মাত্র, তবু নিজস্ব বোধ দ্বারা তাড়িত হয়ে আমি সেগুলো রিভিউ এবং ভেরিফাই করার চেষ্টা করি। কিছু টিকে যায় ফিল্টারিং প্রসেস পার হলে, কিছু খারিজ হয়ে যায়, আর কিছু ক্ষেত্রে অনুসিদ্ধান্তগুলো সিদ্ধান্ত স্তরে পৌঁছে যায়। সিদ্ধান্তে পৌঁছানো মানে চ্যাপ্টার ক্লোজড; সেটা নিয়ে আর ভাবা চলবে না। জীবনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুসিদ্ধান্ত স্তরে অবস্থান করলেও ইমরুল কায়েস আমার বিবেচনাবোধের একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো অধ্যায়। ফলে ২০১৭ এর সাউথ আফ্রিকা সিরিজ থেকে আমি তার ব্যাটিং দেখা বন্ধ করে দিয়েছি। তিনি ফিরবেন, রান করবেন, নতুন কোনো সম্ভাবনাময় কাউকে না পাওয়া পর্যন্ত খেলে যাবেন, তারপর আবার জায়গা হারাবেন; এভাবেই কাটবে ক্যারিয়ার তার। ১০ বছর পেরিয়ে গেছে ক্যারিয়ারের বয়স, বেশিদিন আর অবশিষ্টও নেই। এই পর্যায়ে এসে যদি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরেও যায় খেলার স্টাইল সেখানে ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারবেন না। কেন পারবেন না সেটা বলার পর তার চ্যাপ্টারটা কীভাবে সিদ্ধান্ত স্তরে উন্নীত হলো তাও বলতে চাই।
ইমরুলের হাতে স্ট্রোক আছে সেটা বিভিন্ন সময়েই দেখা গেছে, ২০১১ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচটা স্মরণ করলে তার ব্যাটিং তাণ্ডব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, কিংবা ২০১৬ তে ইংল্যান্ড যখন বাংলাদেশে আসে প্রথম ওয়ানডেতে ক্রিস ওকস এর প্রথম ওভারে যে বিশাল ছক্কাটি হাঁকিয়েছিলেন, মিরপুরের মাঠে বাংলাদেশের কোনো ওপেনার এতো বিশাল ছক্কা মারতে পারেনি কখনো, এটা নিশ্চিত। তবু তিনি স্ট্রোকমেকিংয়ে দুর্বল কেন? তার স্কোরিং জোন খুবই সীমিত, এবং এর চাইতেও বড়ো বিষয় হলো তার করিডোর অব আনসার্টেইনটি এর বিস্তৃতি এবং ব্যাপ্তি দুটোই বেশি। অফ ড্রাইভ করার সময় খুব কম ক্ষেত্রেই তাকে কনফিডেন্ট লাগে, যা বোলারকে উদ্দীপ্ত করে। করিডোর অব আনসার্টেইনটির বিস্তৃতি বেশি হওয়ায় শট খেলার সময় দ্বোমনা ভাব কাজ করে, যেটা কোনো বুদ্ধিমান বা অভিজ্ঞ বোলার খুব সহজেই ধরে ফেলে। ওয়ানডেতে ইমরুল যেসব ইনিংসে রান পেয়েছে বেশিরভাগ ম্যাচেই ওপেনিং স্পেলে অপেক্ষাকৃত তরুণ কিংবা দলে জায়গা স্থায়ী নয় এমন কোনো বোলারই বোলিং করেছে। কোয়ালিটি বোলিংয়র বিপক্ষেও তার রান আছে, কিন্তু বিট হওয়ার পরিমাণও অনেক বেশি সেসব ইনিংসের শুরুতে। দ্বোমনা বা ডিলেমা কাটাতে তিনি চাইলে যোগব্যায়াম কিংবা মেডিটেশন করতে পারেন নিয়মিত।
তবে তামিম নিজের খেলার ধরন বদলে ফেলায় কাজটা তার জন্য আরো কঠিন হয়ে পড়েছে। তামিম এখন আর এগ্রেসর এর রোলে না থেকে শিপ এনংকরিং রোলে বেশি স্বচ্ছন্দ, যে কারণে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে এক্সপেরিমেন্টাল শট খেলতে অনেকটা সময় নিয়ে ফেলে। তাতে খুব সমস্যা নেই, কারণ প্রতিপক্ষ অধিনায়ক-বোলার উভয়েই জানে তিনি তামিম, যে কোনো সময়ই চালিয়ে খেলতে পারেন, তার জন্য স্পেশাল প্ল্যান রেডি রাখতেই হবে। ফলে তামিমের খোলসবন্দী থাকা বরং প্রতিপক্ষের জন্য কিছুটা কনফিউজিং পরিস্থিতি তৈরি করে। কিন্তু রানের চাকা সচল রাখতে হবে, তার সাথে চাই একজন এগ্রেসর; হতে পারে সেটা লিটন, কিংবা সৌম্য- তারা যদি ক্রমাগতই নিজেদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়, তখন প্ল্যান বি বা সি তে যাওয়া ছাড়া উপায়ও থাকে না। একমাত্র তখনই হয়তোবা ইমরুল।
ইমরুল কি তবে ৩এ পারবেন? সেখানেও একই অবস্থাই হবে। ৫ বা ৬ এ নামলে তার একটা সম্ভাবনা থাকতে পারে। তিনি স্পিন বোলিংয়ের বিপক্ষে মোটামুটি স্বচ্ছন্দ, যদিও স্পিনের বিপক্ষে পুশ করে সিঙ্গেল নেয়া ব্যতীত বাড়তি কিছু চেষ্টা করার ক্ষেত্রে তার সীমাবদ্ধতা কাজ করে। তবু পরিশ্রম করে এটা কাটানো হয়তোবা সম্ভব। কিন্তু টপ অর্ডারে খেলতে যে কুলনেস অথবা এরোগেন্স লাগে, কোনোটাই তার ব্যাটিংয়ে নেই। জিম্বাবুইয়ে সিরিজেও তার ব্যাটিংয়ে বিশেষ কোনো পরিবর্তন চোখে পড়েনি, ফিটনেসে উন্নতি ব্যতীত। প্রতিটি ম্যাচেই তার বেশিরভাগ শট ‘করিডোর অব আনসার্টেইনটি’ এর ব্যাপ্তিকে ভাঙতে পারেনি। পারেনি যে তার দৃষ্টান্তস্বরূপ ওয়েস্ট ইন্ডিজি সিরিজে তার ব্যাটিংয়ে নজর রাখতে অনুরোধ করবো আপনাকে। কেমার রোচ বা হোল্ডার যখন বোলিং করে, দেখবেন শুরুতেই স্লিপ এ ২-৩টা এজড হবে, ভাগ্য প্রসন্ন হলে থার্ডম্যান দিয়ে চার হবে, অথবা স্লিপ এ কট, কিংবা টপ এজড হয়ে সার্কেলে ক্যাচ। রোচ আর হোল্ডার ব্যতীত বাকি পেসারদের চিনি না বলে প্রেডিক্ট করাটা কঠিন হচ্ছে। তবে উল্লিখিত বোলার দুজনের বোলিংয়ের বিপক্ষে ইমরুলের ব্যাটিংটা মনোযোগ দিয়ে দেখতে ভুলবেন না।
এবার আসা যাক সিদ্ধান্ত পৌঁছানোর জার্নিতে।
প্রথমত, ইমরুল কায়েসের রানিং। আপনি খেয়াল করে দেখবেন, তার সাথে প্রায় প্রত্যেক পার্টনারের ভুল বোঝাবুঝি হয়। রান নিতে গিয়ে মাঝপথে সিদ্ধান্ত বদলে ফেলা, কিংবা ২ পার্টনার একই প্রান্তে চলে আসা, এটা অহরহই ঘটে। তিনি ২৯+ রান করেছেন অথচ পার্টনারের সাথে অন্তত ২ বার মিসকমিউনিকেশন হয়নি এমন দৃষ্টান্ত খুবই কম। এই জায়গায় সাব্বির আর ইমরুলের মধ্যে জোর প্রতিদ্বন্দ্বীতা হতে পারে। আমি নিশ্চিত নই, তবে অনুমানের বশে বলতে পারি, বাংলাদেশের টপ আর মিডল অর্ডারে ব্যাট করা ব্যাটসম্যানদের মধ্যে যদি জরিপ চালানো হয়, কার সাথে ব্যাটিং করতে গেলে রান আউটের ভয় বেশি কাজ করে, ইমরুলের নামটাই বেশি আসবে।
দ্বিতীয়ত, বিগত ২৩ বছরে যতজন ওপেনারের ব্যাটিং দেখেছি, মাঝব্যাটের বদলে কোনা-কাঞ্চিতে বল লাগানোর তালিকায় সবার ওপরে থাকবে ইমরুল কায়েস। তার মিডলিং পারসেন্টেজ খুবই হতাশাজনক। একজন ব্যাটসম্যান যতো রানই করুক, মিডলিং কম হলে তার মধ্যে সেট হওয়ার ফিলিং আসে না। যেকারণে ইমরুলকে সবসময়ই নড়বড়ে লাগে। মিডলিং এতো কম হওয়ার কারণ কী থাকতে পারে? ঔনারশিপ গ্রো না করা। কিসের ঔনারশিপ? নিজের ব্যাটিং সামর্থ্যের ওপর। তিনি স্বভাবগত সাবমিসিভ বা সমর্পিত মানসিকতার ব্যাটসম্যান। তিনি নিজের সুনির্দিষ্ট রোল বুঝতে পারেন না, যে কারণে এতো বছরেও তার কোনো ট্রেডমার্ক শট তৈরি হয়নি। বাংলাদেশের হয়ে ২৩টির বেশি ওয়ানডে খেলা প্রত্যেক ব্যাটসম্যানের একটি ট্রেডমার্ক শট বলা সম্ভব। হোক সে নাসির, জাভেদ ওমর কিংবা মেহরাব হোসেন অপি। কিন্তু ইমরুলের কোন শটটাকে ট্রেডমার্ক বলা যায় যেটা দিয়ে তাকে আলাদা করা যায়? মনে করার চেষ্টা করুন; পাওয়ার সম্ভাবনা দেখি না।
তবু ইমরুলের প্রতি সিমপ্যাথেটিক মানুষের সংখ্যা এতো বেশি কেন, তাকে এতো ট্রলই বা কেন করা হয়?
ইমরুল জনসংখ্যায় ঠাঁসা দেশের লক্ষ-কোটি অমেধাবী মানুষের প্রতিচ্ছবি, যারা সবকিছুতে স্বজনপ্রীতি আবিষ্কার করে, উপার্জন করতে চায় কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়েই দক্ষতা তৈরিতে আন্তরিক হয় না, ফলে নিজের দূরবস্থার জন্য কখনো রাষ্ট্র, কখনো সমাজের নামে বিষোদগার করে। এদের সাথে কথা বলতে গেলে দেখা যায়, এর অমুক আত্মীয় তমুক বড়ো ভাই অমুক ক্ষমতাসীন জায়গায় আছে, কিন্তু নিজেদের অবস্থান কী, অর্জন কী সে সংক্রান্ত একটি শব্দও নেই, একদম ফুলস্টপ। ইমরুলের মাঝে তারা নিজেদের সেই বঞ্চনা দেখে। তারা খেলেও যে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখে তাও নয়। যদিবা বসে, বিপক্ষ দলের ব্যাটসম্যান চার মারলে বোলারকে গালি দেয়, ব্যাটসম্যান আউট হলে তাকে গালি দেয়; খেলাটা তাদের কাছে না ইন্টারটেইনমেন্ট না টাইম পাস, কারো কারো কাছে দেশপ্রেমেরও বহিঃপ্রকাশ। ফলে কোনো প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান দেখলে তারা তাকে মানসিকভাবে চ্যালেঞ্জ জানায়; বালের ট্যালেন্ট আইছে আমার। সেই ব্যাটসম্যান পারফরম করে ফেললে তারা অস্বস্তিতে পড়ে যায়, নিজেদের প্রতিভাহীনতাকে বোঝা মনে হতে থাকে। বোলারদের নিয়ে ডিল করতে ক্রিকেট সম্বন্ধে আরেকটু প্রজ্ঞা লাগে, যেহেতু উইকেট পাওয়াটা বলে বলে সম্ভব নয়। তখন বোলার বিচারের মানদণ্ড হয়ে যায় সে কতগুলো চার বা ছক্কা হজম করলো। সে নিজে ক্রিকেটার নয়, তবু ‘প্রতিভা’ শব্দটাই তাদের এলার্জি বাড়িয়ে দেয়।
পক্ষান্তরে ইমরুল নিজেদের দক্ষতার অভাবে বিট হচ্ছে কিনা, রানিংয়ের ক্ষেত্রে পার্টনারকে বিভ্রান্ত করছে কিনা, কিংবা শট মিডলিং করতে পারছে কিনা এসব সূক্ষ্ম বিষয়াদি মাথায় থাকে না, মাথায় ঘোরে ‘প্রতিভা চ্যাটের বাল’, ইমরুল সেই জায়গাটায় ঢুকে পড়ে যখন তাকে আপন মনে হয়। ইমরুল চেজ করতে পারবে কিনা সেটা বড়ো কথা নয় বাংলাদেশ আগে ব্যাট করে ২৬৩+ করতে পারলো কিনা কিংবা চেজ করতে গিয়ে কাছাকাছি গেলো কিনা সেটাই আসল বিবেচ্য। ইংল্যান্ড বা ভারতকে যে হারানো সম্ভব এটা তারা দাবি করে, বিশ্বাস করে না, কারণ তাদের মতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রায় সব দেশই ষড়যন্ত্র করে বা অন্যায় সুবিধা নিয়ে ম্যাচ জিতে; ইংল্যান্ড-ভারত কোনোভাবেই বাংলাদেশের চাইতে শ্রেয়তর দল নয়। এবং বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সম্ভাবনা কেমন জিজ্ঞেস করলে তারা বলবে চ্যাম্পিয়ন হবো ইনশাল্লাহ; কিন্তু চ্যাম্পিয়ন দলের স্ট্র্যাটেজি কেমন হয় সে সংক্রান্ত কোনো মূল্যায়ন বা ভাবনারই অস্তিত্ব নেই।
ইমরুলের থেকে আমার কোনো প্রত্যাশা নেই। নিজের প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি দিয়ে তিনি যদি ফেরতই আসেন, একজন ব্যাক আপ প্লেয়ার হিসেবে বিশ্বকাপ দলে তাকে রাখাই যেতে পারে। ২০১৫ বিশ্বকাপেও তো দলে ছিলেন না শুরুতে, বিজয় ইনজুরিতে পড়ে দেশে ফেরত আসার পর ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ভারতের বিপক্ষে ৩টা ম্যাচে খেলেছিলেন, এবং নৈপুণ্যের সর্বোচ্চটা উগড়ে দিয়েছেন। উগড়ে দেয়া জিনিস তো ছড়িয়ে-ছিটিয়েই থাকবে।
আমরা একটা কথা প্রায়ই শুনি। প্রতিভা বলতে কিছু নেই, পরিশ্রমই সব। কথাটা ভুল। পরিশ্রম মানে কেবল গায়ে-গতরে খাটা নয়, একনাগাড়ে কোনোকিছুতে সময় দেয়া ও প্রতিনিয়ত সেই সময়ের রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট হিসাব করা- একেই পরিশ্রম বলা যেতে পারে। তবু যে কোনোকিছুর সর্বোচ্চস্তরে পৌঁছুতে ন্যূনতম হলেও প্রতিভা লাগে। এই কথাটা উহ্য রাখা হয়, যাতে প্রতিভাবানরা রিল্যাক্সড না হয়ে যায়, এবং পরিশ্রমকে অবহেলা না করে বরং পরিশ্রমীদের উদ্যম দেখে নিজেদর অস্তিত্ব রক্ষায় সচেতন হয়।
আমার সংজ্ঞায় ইমরুলকে পরিশ্রমী, প্রতিভাবান কোনোটাই বলতে পারি না- এই ব্যর্থতার দায় আমার সংজ্ঞার, দর্শকের নয়। ইমরুল তবে কী?
একজন ক্রিকেটার যিনি নিপাট ভদ্রলোক।