গ্লোবালি তারুণ্য বা ইয়ুথ হ্রাস পাচ্ছে, বৃদ্ধি পাচ্ছে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা, তার রেশ পড়ছে বাংলাদেশেও। ২০৩০ সালের পর পৃথিবীটা কেমন হবে, বিশেষ করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কল্পনা করতে গিয়ে অপরিমেয় বিষণ্নতায় ভুগছি।
তারুণ্য হ্রাস পাচ্ছে এবং আরও পাবে, এতে আমার খুবই মন খারাপ, এ ব্যাপারে ভনিতার কিছু নেই। পৃথিবীকে বৈচিত্র্যময় রাখে তরুণরাই, বয়স্ক মানুষ অনাগত ভয় আর নিজস্ব গণ্ডির জীবনে স্বচ্ছন্দ্য। এ কোন্ পৃথিবীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি ভাবতেই বিরক্তি ভর করে নিজের মধ্যে। ১৩ বছর পরে আমি নিজেও শারীরিকভাবে তরুণ থাকবো না, আমিও হয়তোবা ঢুকে পড়বো জরাগ্রস্ততার বলয়ে, কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে ১০-১৫ বছর আগে হিউম্যান রিসোর্সের যোগান এতো বেশি ছিলো যে জাগতিক নিয়মে তরুণরা বয়স্ক হয়ে গেলেও একই বয়সের মানুষ উঠে আসায় ব্যালান্স বা ভারসাম্য ঠিকই বজায় থাকতো। ফলে ঘাটতিটা টের পাওয়া যায়নি। কিন্তু এখন পৃথিবীতে অনেক দেশই আছে যেখানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নেগেটিভ, এবং এটাকে এপ্রিশিয়েট করা হচ্ছে, যার দেখাদেখি আরও বেশ কিছু দেশ জনসংখ্যার নিম্নবৃদ্ধিহারকে সিরিয়াসলি নিচ্ছে। ফলে নিচের দিকে যোগান খুবই কম, তরুণরা বয়স্ক হচ্ছে, সেই অনুপাতে শিশু-কিশোর নেই, যারা তারুণ্যে পৌঁছুবে। পৃথিবীব্যাপী এই যে পপুলেশন চেইনে মেরুকরণ, এটা দুর্লক্ষণ।
আমি ইকোনেমিক্স এবং পলিটিক্স খুব ভালো বুঝি না, এসব ব্যাপারে বোদ্ধা মতামত দেয়ার যোগ্যতাই নেই। তবু ধারণা করি, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ একটি গভীর পলিটিকাল স্ট্র্যাটেজির অংশ। এর মধ্যে শ্রেণি বৈষম্য এবং ইন্দ্রিয়বাদী দর্শনের কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে।
আমাদের আগের প্রজন্মেও দেখেছি, পরিবার মানে সেখানে দাদা-দাদী, চাচা-চাচী, খালা-ফুফু, মামা, নানা-নানী এর বিশাল বহর। আমার বাবারা মোট ৮ ভাই-বোন ছিলেন। ফলে আমাদের বেড়ে ওঠার সময় সম্পর্কের বিবিধ মাত্রা বা ডাইমেনশন দেখেছি, সংকট যেমন ছিলো, আনন্দও তেমন। সময় এগিয়েছে, বিশ্বপট বদলেছে, লাইফস্টাইল কনসেপ্টেই এসেছে মহামারী আকারের ভোগবিলাস দর্শন। তার প্রতাপে এতো বিপুল জনগ্রষ্ঠীর কর্মসংস্থান করতে সরকার হিমশিম খায়, অন্নসংস্থান নেই, জনসংখ্যার ঘনত্বের কারণে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে এরকম আরও কত থিওরি। ‘ছেলে হোক, মেয়ে হোক দুটি সন্তানই যথেষ্ট’- আমাদের শৈশব-কৈশোরে এই শ্লোগান প্রচুর শুনেছি, তার ইমপ্লিমেন্টেশন দেখতে পাচ্ছি এখন। মিডলক্লাস ফ্যামিলিগুলোতে এখন মাইক্রোস্কোপ দিয়ে খুঁজলেও ২টির বেশি বাচ্চা খুঁজে পাওয়া যাবে না, বরং এখনকার থিম হলো ‘দুটির বেশি সন্তান নয়, ১টি হলে ভালো হয়’। সর্বশেষ ১৫ বছরে যারা বাবা-মা হয়েছেন মিডল ক্লাস এ, একটু স্ট্যাটিসটিকালি হিসাব করে দেখুন ৭০% এরও বেশি ক্ষেত্রে ১টি সন্তান। ফলে ২০৩০ পরবর্তী বাংলাদেশে চাচা-ফুফু বা মামা-খালা বলতে কোনো সম্পর্ক থাকবে না, আত্মকেন্দ্রিক এক জীবন নিয়ে বড় হবে ক্ষয়িষ্ণু তরুণ, যারা হয়তোবা কম্পিউটারের ভেতরে ভারচুয়াল রিয়েলিটি আবিষ্কারে মত্ত থাকবে, দুজন মানুষ পাশাপাশি বসে একে অপরের সাথে ফেসবুক বা অন্য কোনো মিডিয়ামের সহায়তায় চ্যাট করবে, কিন্তু মুখে কথা বলবে না। আমার বীক্ষণ প্রান্ত বইয়ের ‘ঢ়-তত্ত্ব’ গল্পের শেষ লাইনটা তখন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে ‘হাত ছোঁয়া দূরত্বে দুজন মানুষ, কিন্তু তারা বাস করে ভিন্ন দুটি রাষ্ট্রে’।
এলিয়েনেশন বা বিচ্ছিন্নতা আধুনিক পৃথিবীর প্রার্থিত জীবন। আমরা ব্যক্তিস্বাধীনতা, প্রাইভেসি, ফ্রিডম, স্পেস প্রভৃতি কনসেপ্টকে এতো গভীরভাবে ভালোবাসি যে, ক্রিটিকালি এগুলো বিশ্লেষণ করতে যাওয়াকে জড়বুদ্ধিতা, মধ্যযুগীয় ভাবনা, সহজ কথায় ‘মেইনস্ট্রিম’ ট্যাগ দেয়া হয়, কারণ এইসব লোভনীয় কনসেপ্টের ধারক-বাহকেরা বিশ্বসভ্যতার ইতিহাস মুখস্থ করে ফেলেছেন, তারা সেই লব্ধ জ্ঞান অক্ষরে কনভার্ট করতে বিপুল পারদর্শী, তাদের লেখনী অনুসারে ‘মেইনস্ট্রিম’ একটি গালিবিশেষ বা ক্ষেত্রেবিশেষে অধঃপতন ইন্ডিকেটর। এতোটা বয়স হয়ে গেলো, এখনো ‘মেইনস্ট্রিম’ কথাটার মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারলাম না এই আফসোসেই শেষ হয়ে যাই মাঝে মাঝে।
পক্ষান্তরে নিম্নবিত্ত বা প্রান্তিক গোষ্ঠীর মধ্যে সন্তান জন্মদানের ব্যাপারে খুব বেশি পরিবর্তন আসেনি। এখনো তারা অবলীলায় ৫-৬টি সন্তান জন্ম দিতে পারে। এতে করে পথশিশু, ভাসমান মানুষের সংখ্যা বাড়ে, অথচ যাদের সামর্থ্য আছে, যারা একটি দেশকে এগিয়ে নিতে পারে, পৃথিবীকে আলোকিত করতে পারে সেই মধ্যবিত্তদের মধ্যে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে অদ্ভুত অনীহা। ক্যারিয়ার, স্ট্যাবলিটি, রেসপনসিবিলিটি, ইনসিকিউরিটি প্রভৃতি কনসেপ্টগুলো মিডিলক্লাসের মগজ এতো সুনিপুণভাবে ধোলাই করেছে যে, এই জট থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।
তারুণ্য কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে দায়ী কে, এই প্রশ্নের উত্তর নেই। কারণ টোটাল ক্যানভাসটা এতো ব্যাপক যে, এটাকে একরৈখিক কোনো মতবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। যেমন, মিডলক্লাস ফ্যামিলির একটা ছেলের বিয়ের বয়স কত হওয়া উচিত এটারই সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। সেশন জট শেষ করে চাকরি পেলেই বিয়ে করবে সেই সিচুয়েশন সিংহভাগ ছেলেরই থাকে না। কারণ, তাকে ফ্যামিলির দায়িত্ব নিতে হয়, বিয়ের খরচ যোগাড় করতে হয়, ততদিনে বয়স ৩০ পার হয়ে যায় কোন ফাঁকে সেই হিসাব খেয়ালই থাকে না। অন্যদিকে, বয়সজনিত প্রেম-রোমান্সের হার অন্য যে কোনো সময়ের চাইতে অনেক বেশি, স্কুলে থাকতেই অনেকে জড়িয়ে পড়ে সম্পর্কে, কলেজ আর ভার্সিটিতে তো এই হার আরও বেশি। আগে বিয়ের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী এর মধ্যে বয়সের পার্থক্য থাকতো, প্রেম-রোমান্সের আধিক্যে সমবয়সী বিয়ের হারও বাড়ছে। একটা ছেলে অনার্স শেষ করেই অকূল পাথারে পড়ে যায়, তার জন্য অপেক্ষা করে আছে কেউ। দেনমোহরের টাকা, কমিউনিটি সেন্টার, গহনা, ফটোশুট এতোসব বিলাসীতার যোগান দেয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য কই? সবমিলিয়ে এক ধরনের ইমব্যাল্যান্স, বিবাহবহির্ভূত যৌনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই ধরনের ইমব্যাল্যান্সের সোশ্যাল ইমপ্যাক্ট আছে ধারণা করি।
এক সময় প্রতিবেশী ছিলো আশপাশের বাড়ি মিলিয়ে, পরস্পরের মধ্যে সৌহাদ্র্য বজায় থাকতো, বিশেষত গ্রামের দিকে। এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রাম পর্যন্ত মানুষগুলো একে অপরের পরিচিত ছিলো। নগরায়নের ফলে এখন ভার্টিকালি প্রতিবেশী বাড়ছে। একখণ্ড জমিতে ১৬ তলা বিল্ডিং তুললে একই জায়গায় কতগুলো ফ্যামিলি, কতগুলো প্রতিবেশী, কিন্তু কেউ কাউকে চেনে না। এমনকি পাশের ফ্ল্যাটে কে আছে সেটাও জানা হয় না বেশিরভাগ সময়। এই যে প্রকট আত্মকেন্দ্রিক জীবনকে আলিঙ্গন করে নেয়ার একাকী আনন্দ, সেখানে নতুন করে উটকো ঝামেলা বাড়ানোর ইচ্ছেটাও কমে আসছে ইদানীং। জন্মনিরোধকের ব্যাপক প্রসার বিশ্বজুড়েই সন্তানকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে প্রোসপেক্টিভ বাবা-মা এর মুখোমুখি, যে বয়সটা মা-বাবা হওয়ার জন্য পারফেক্ট, প্রকৃতি চাচ্ছে নতুন প্রাণ সেই সময়টা ব্যয় হয়ে যাচ্ছে ক্যারিয়ারের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী করতে; বাচ্চা হলে কে তার দায়িত্ব নিবে, কতটুকু সময় দিতে পারবে- এইসব নেগেটিভ থিংকিংয়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত, নাগরিক সমাজ কেবলই ঝুঁকে পড়ছে ‘ছেলে না হোক, মেয়ে না হোক, তুমি আমি যথেষ্ট’ নীতিতে। পাশাপাশি বাড়ছে বিবাহ বিচ্ছেদ সংখ্যা, অন্য যে কোনো সময়ের চাইতে পরকীয়া বেড়েছে, মেন্টালিটি মিলছে না অভিযোগ বেড়েছে, টলারেন্স বা সহনশীলতা কমেছে ভয়ানকভাবে; ফলে ডিভোর্স হলে বাচ্চাদের পরিণতি কী হবে, এটাও একটা অমীমাংসিত প্রশ্ন আকারে উত্থাপিত হচ্ছে। কিন্তু যৌনতা, কাম কোনোকিছুই কমেনি, এমনকি গর্ভপাতের হারও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞাপন, মিডিয়া, লাইফস্টাইল সবকিছুর মধ্যেই সূক্ষ্মভাবে পুশ করা হচ্ছে সেক্স ইনস্টিংট, শুধু নতুন প্রাণের উদ্বোধনের বেলাতেই প্রধানমন্ত্রীর পর্যায়ের সতর্কতা।
পরিবেশগত পরিবর্তনও একটা বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে । কিছুদিন আগে একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম বাংলাদেশের ৫০% মেয়ে PCO বা কোনো না কোনো হরমোনাল সমস্যায় ভুগছে, যে কারণে ফার্টিলিটি কমে যাচ্ছে। জলবায়ু, খাদ্যাভ্যাসের সাথে এই সমস্যার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।
আমি জীবনে প্রচুর বই পড়েছি, কিন্তু কোনো বইয়ের কথাই মনে থাকে না, কারণ খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া হয় না, স্রেফ স্কিম করে যাই। প্লেটোর একটা বই পড়েছিলাম, সেখানে তিনি একটা তত্ত্ব দিয়েছিলেন যেটা সম্ভবত এমন, শিশুদের উপর সম্পূর্ণ অধিকার রাষ্ট্রের, তাদের বাবা কে বা মা কে, এটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন করে না। নেগেটিভ জনসংখ্যা গ্রোথের দেশগুলোতে বাচ্চাদের জন্য প্রচুর ইনসেনটিভ থাকে, বাচ্চা হলে বাবা-মা আর্থিকভাবে লাভবান হয়, তবু তারা সন্তান গ্রহণে অনাগ্রহী, কারণ বন্ডিং, রেসপনসিবিলিটি প্রভৃতি আরোপিত ব্যাপারগুলো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই পছন্দ করে না। আমরা রুচিশীল, আমরা সংস্কৃতিমনা, আমরা চিন্তাশীল, কেবল সন্তানের বেলায় আমরা রক্ষণশীল, কারণ ভোগবিলাসী দর্শন সন্তানকে এফোর্ড করতে পারে না। আমাদের ছোটবেলায় পরীক্ষায় রচনা আসতো পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য, এখনকার ব্যাকরণ বইগুলো তন্নতন্ন করেও পরিবার বিষয়ক কোনো লেখা পাওয়া যাবে না।
আগামীর পৃথিবী হবে যন্ত্রের, সায়েন্স ফিকশন বইগুলোর মতো যদি বলি, রোবট চালাবে পৃথিবী। সমস্ত শ্রমিক ছাঁটাই হয়ে যাবে, কেরানির প্রয়োজন পড়বে না, দরকার শুধু কাস্টমার। সেটার জন্য নিম্নবিত্ত মানুষরা তো থাকবেই, তারা টিকে থাকার সংগ্রাম করবে, লড়াই করবে, আর আরামপ্রিয় বিচ্ছিন্ন একাকী মধ্যবিত্তরা ভোগবিলাসের মধ্য দিয়ে ইন্দ্রিয়পূর্তি করবে, যেহেতু কর্মীর দরকার নেই, সেক্ষেত্রে তরুণের সংখ্যা বাড়লো কি কমলো তাতে কী আসে যায়!
নতুন আবিষ্কারের প্রয়োজন নেই, নতুন দর্শনের চাহিদা নেই, জীবনবোধ পাল্টানোর তাগিদ নেই; পৃথিবীজুড়ে কেবল ‘নেই’ এর কলরোল। এখন যা কিছু হয় বেশিরভাগই এপ্লিকেশন বা এডাপ্টেশন, মৌলিক আবিষ্কারের ক্ষেত্র ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। গবেষণা বেড়েছে, আবিষ্কার বেড়েছে, কিন্তু মৌলিক খুবই কম, সবই নিউটন, আইনস্টাইন বা কোয়ান্টাম ফিজিক্সের এদিক-সেদিক করা। আমরা বোধঘহয় উৎকর্ষের একটা ছার্টেইন লেভেল পার করে ফেলেছি, যেখান থেকে ইনোভেশনের খুব বেশি দেয়ার নেই। এই অনুর্বর পৃথিবীতে তরুণরা করবে কী!
তবু আমার বিষণ্নতাকে ভুলতে পারি না, বৈচিত্র্যময় পৃথিবী দেখার লোভ সংবরণ করতে পারি না, বয়স্ক মানুষের অরণ্যে মিশে যেতে যেতেও আমি তরুণদেরই সদম্ভ পদচারণা দেখতে চাই। কিন্তু ট্রিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্টের যে সিস্টেম, সেখানে পিঁপড়ার চাইতে ক্ষুদ্র এক মানুষ যার পকেটে ১০০ টাকাও থাকে না অনেক সময়ই, তার চাওয়া না চাওয়া এক মুঠো ছাঁইয়ের চাইতেও মূল্যহীন।
হে মিডলক্লাশ দম্পতিগণ, আপনারা অন্তত ৩-৪ জন সন্তানের পিতা-মাতা হয়ে তারুণ্যের যোগান অব্যাহত রাখুন, পৃথিবীটা সুন্দর থাকুক। জরাগ্রস্ত মানুষ বড্ড বোরিং…..