একই টাইমজোনে স্পেস এবং সময় শেয়ার করলাম, আরমান এবং আমি। হতে পারে শেষবারের মতো, কিংবা টুইস্টে ভরপুর জীবনফিল্মে অপেক্ষায় থাকা অচেনা ক্লাইম্যাক্সের। আগামীকাল আমেরিকায় উড়াল দিচ্ছে। এখনকার লক্ষ্য পিএইচডি অর্জন। একাডেমিক লাইনে ক্যারিয়ার গড়েছে (এসিসট্যান্ট প্রফেসর,বুয়েট), পিএইচডি করতে হতোই, বরং এত বিলম্ব কেন করলো এটাই প্রশ্নের জন্ম দেয়।
এবং পূর্বসুরীদের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে চাকরিসূত্রে সেখানেই স্থায়ী হয়ে যাওয়ার পর্যাপ্ত সম্ভাবনা।
বাংলাদেশে আমার অনুরাগী, শুভাকাংখী অগণিত, বন্ধু-আসক্তির সংখ্যাও ছোট নয়, তবু যদি প্যারামিটার সেট করি এমন একজন মানুষ যার সাথে মাথা একপাশে খুলে রেখে সারাদিন গল্প করা যায়, কিছু মনে করলো কিনা সংশয় কাজ করে না, আমার বাহ্যিক আচরণের চাইতে অভ্যন্তরীণ মনোজগত বোঝার ব্যাপারে আন্তরিক— দেখা যাবে আরমানের বাইরে অবশিষ্ট নেই একজনও।
আরমান আমার ক্রিয়েটিভ ওয়ার্কের একজন প্রভাবশালী ক্যারেক্টারও। আমার ৩-৪টা বইতে ওকে পাওয়া যায়, আমার নির্মিত দুটো ফিল্মেও অভিনয় করেছে।
আমার অন্যান্য ক্যারেক্টারদের বিনির্মাণ করতে হয়েছে, অর্থাৎ বই আর বাস্তবের মানুষে প্রভেদ হিমালয়সম। আরমানের ক্ষেত্রে সেই প্রভেদ অতি সামান্য।
বাংলাদেশে আমি কি তবে একা হয়ে গেলাম? যোগাযোগের প্রচলিত মাধ্যম বলতে সাধারণত দেখা বা কথা হওয়া, অন্যের কাছ থেকে আপডেট জানা কিংবা মেসেজ পাঠানো বোঝানো হয়, সবগুলোই যদি থেমে যায়, সেটা কি তবে যোগাযোগহীনতা?
কখনোই না।
মাইগ্রেশন আমার অত্যন্ত পছন্দের বিষয়। প্রাচীন মানুষেরা যদি আফ্রিকা থেকে এশিয়া পানে রওয়ানা না দিত, কোথায় থাকত মানুষের তৈরি সভ্যতা! জেনেটিকালিই মানুষ যাযাবর প্রাণী, আমার ধারণা। ছোট স্কেলেও মানুষ মাইগ্রেট করে। যার জন্ম এবং বেড়ে উঠা ভোলা দ্বীপে সে ঢাকায় সেটেলড হলো কীভাবে! আরমান ওর জীবনের দীর্ঘতম অংশ বাংলাদেশে অতিবাহিত করলো, ওর দেড় বয়সী কন্যার স্মৃতিতে কোথাও বাংলাদেশ থাকবে না, ওর পৃথিবী হবে অন্য কোথাও। এটাই বেঁচে থাকার সৌন্দর্য৷ স্বজাত্যবোধ, দেশাত্মবোধ প্রভৃতি ক্যাম্পেইন দিয়ে মানুষের মাইগ্রেশন আটকানো যাবে কি?
বিশ্বাস হয় না।
আমি বাংলাদেশে থাকি দুটো কারণে৷ প্রথমত ইউরোপ বা আমেরিকার প্রচণ্ড ইনডিভিজুয়ালিস্ট কালচারে টিকে থাকার স্মার্টনেসে ঘাটতি আছে বুঝতে পারি। দ্বিতীয়ত, বসবাসের জন্য বাংলাদেশ খুবই এক্সাইটিং লাগে। এখানকার সিংহভাগ মানুষ ননসেন্স এবং ইডিয়ট প্রকৃতির, আর থরে বিথরে চৌধুরি সাহেব। এখানে উইয়ার্ড সব কারণে মানুষের বিবাদ বাঁধে, এখানে ২য় বা ৩য় পক্ষের মাধ্যমে শোনা কথাকে ভিত্তি ধরে সম্পর্কের অবনতি ঘটে, সুযোগের অভাবে সৎ, এবসার্ড উপায়ে মারা যায় মানুষ—- এরকম ইউনিক এক্সপেরিয়েন্স অন্য কোথাও হওয়া সম্ভব নয়।
তবে মানুষ পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশ একেবারেই মানসম্মত জায়গা নয়। আয়তনে এতই ক্ষুদ্র পুরো দেশটাই হোমোজেনাস; লাইফস্টাইল সর্বত্র কম বেশি কাছাকাছি।
আমার ইচ্ছা করে ১-২ মাস বিভিন্ন দেশে থেকে সেখানকার লাইফস্টাইল বোঝা। মিশর, গ্রিস, ইতালি, ইরাক এর প্রতি বিশেষ আকর্ষণ কাজ করে। আসক্তি বোধ করি জার্মানি, রাশিয়া, চীন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, তুরস্কের প্রতি। বিশেষ রোমান্টিকতা তৈরি হয় ডেনমার্ক, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, ফিলিপাইনকে ঘিরে।
তবে আমেরিকা, কানাডা এবং ইংল্যান্ড ন্যূনতম আকর্ষণেও সমর্থ হয় না। সম্ভবত সিংহভাগ বাঙালির আগ্রহের হটলিস্টে এই ৩ দেশের অবস্থান দেখেই অনাগ্রহটা চূড়ায় উঠেছে। আমেরিকা বা কানাডাকে মনে হয় আরেকটা বেদের মেয়ে জোছনা। এবং মানুষ ওসব দেশে মাইগ্রেশন করছে নাকি শরিয়তপুর থেকে ঢাকায় আসছে, বুঝতে পারি না।
আরমানকে বললাম তোর যা পারসোনালিটি প্যাটার্ন আমেরিকা তোর ভালো লাগবে না। খুবই সম্ভাবনা আছে তুই পরবর্তীতে অন্য কোনো দেশে মাইগ্রেট করবি।
৭ বছর আগেও আমার কাছে অর্থ উপার্জনের শক্তিশালী কারণ ছিল না। এক সময় কারণ হিসেবে পাই শখ পূরণের ক্ষেত্রে টাকা যেন বাধা হয়ে না উঠে। এক পর্যায়ে আবিষ্কার করি আমার বইয়ের ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ক্যারেক্টারদের ৮০%ই প্রবাসী, তাদের সশরীরে ইন্টারভিউ নেয়ার জন্য হলেও বিদেশে যেতে হবে। এজন্য অর্থ উপার্জন করা উচিত।
আজ যখন আরমানও নিশ্চিত করলো বুয়েট ক্যাম্পাসে গেলে গল্প করার শেষ মানুষটিও অন্য আকাশের ভূখণ্ডতে চলে যাচ্ছে, চূড়ান্তভাবে উপলব্ধি করলাম কূপমণ্ডুকতার অভিশাপ কাটাতে হলেও অর্থ উপার্জন আবশ্যক।
এতটা বয়স অবধি পাসপোর্টই করা হয়নি, দুনিয়া দেখব কী!
আরমান তোর কন্যা রুকাইয়াত গ্রেড ২ তে উঠার আগেই আমেরিকায় তোর বাসায় গিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করে আসব; ৭৯টা কমিটমেন্টের মধ্যে তোর জন্য ১টা বরাদ্দ দিলাম। এই কমিটমেন্ট ভঙ্গ করবো না, সুস্থ্য থাকলে।
বিদায়বেলাটা সেলিব্রেশনে কেউ কেউ খাওয়া দাওয়া করে, কেউবা দেয় উপহার। আমার পছন্দ ছিল দিনভর গল্প করা। কিন্তু গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই ওর মায়ের ভয়ানক অসুস্থতায় পছন্দটা বাস্তবায়ন করা হলো না। উপহার চিন্তার সময় যা ভাবি, অনুভব করি এগুলো কেউ না কেউ দিবে৷ এমন কিছু দেয়া উচিত যা বিদায়বেলায় কেউ কোনোভাবেই প্রত্যাশা করে না। শেষমেষ মাথায় এলো খেলনা র্যাকেট। একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর অন্তিম উপহারের ১০০ টা অপশন রাখলেও সেখানে এটার স্থান হওয়ার কারণ দেখি না।
বিপরীতক্রমে আরমানের থেকে পেলাম ১টি ডলারের নোট। শুনলাম ডলারের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে, এরকম ক্রান্তিলগ্নে একটি ডলার কন্ট্রিবিউট করে আরমান দেশ ও দশের যে অভাবনীয় উপকার করলো, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সিদ্ধান্ত নিয়েছি ডলারের নোটটা লেমিনেট করে টাঙিয়ে রাখব কিছুদিন।
সম্পর্ক, প্রেম, অতীত, বস্তু, মানুষ— কোনোকিছুই সংরক্ষণ করতে পারি না। হারিয়ে ফেলি বা ভুলে যাই। আরমানের নোটটার আয়ু কতদিনের হয়, দেখতেই পারি।
প্রস্থানে মন খারাপ হয় না। যোগাযোগের জন্য শরীর কোনো ফ্যাক্টর নয়। আরমানের ব্যাপারটাও অভিন্ন। তবু ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছে গত ১০ বছরে আরেকটু বেশি সময় কি শেয়ার করতে পারতাম? কেন হলো না?
হে সময়, তোমায় আমি ক্ষমা করলাম, পারলে তুমিও করো আমায়