৩২ বছরের জীবনে সাড়ে১৫ বছর ধরে ঢাকায় বসবাস করলেও নিজেকে সর্বদাই ঢাকায় রিফিউজি বা শরণার্থী মনে হয় আমার। ঢাকার নিকটবর্তী জেলাসমূহের নাম বললে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জের সাথে আরো একটি নাম হরহামেশাই চলে আসে- মানিকগঞ্জ। ১৯৯৪ এর ২৬ শে জানুয়ারি থেকে ২০০৩ এর ১৭ই আগস্ট, ৯ বছর ৭ মাসের কিছু বেশি সময় মানিকগঞ্জ সদরে অস্তিত্ব বিকশিত হয়েছে আমার। তার আগের সময়টা ছিলাম মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলায়। যদি কোনোদিন বীতশ্রদ্ধ হয়ে ফিনল্যান্ড কিংবা ডেনমার্কে চলে যাইও, তবু ‘আমার শহর’ কথাটা আমৃত্যু মানিকগঞ্জের জন্যই প্রযোজ্য হবে।
মানিকগঞ্জ শহরের গুণকীর্তন কিংবা পরিচিতি প্রদানের উদ্দেশ্যে এই লেখার সূত্রপাত নয় তা বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশ বলতে আদতে আমি দুটো দেশীয় ব্যবস্থা বুঝি- ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে। চাই কি, চট্টগ্রাম আর সিলেটকেও কিছু নম্বর গ্রেস দিয়ে হয়তোবা ঢাকার কাতারে রাখা যায়, কিন্তু বাকি জেলাগুলোর মধ্যে জীবনব্যবস্থায় আহামরি কোনো পার্থক্য নেই। ঢাকাকে যদি শহর বলি, অন্য জেলাগুলোকে নির্দ্বিধায় উপশহর বলা যেতে পারে। মানিকগঞ্জকে তাই ‘স্যাম্পল’ হিসেবে নিচ্ছি যাতে উপশহরগুলোর জীবনকাঠামোতে পরিবর্তন এবং সেখানকার অধিবাসীদের মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনগুলো নিয়ে একটি হাইপোথিসিস দাঁড় করানো যেতে পারে।
ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হলে আমিনবাজার পার হওয়ার পরই একটা পরিবর্তন টের পাবেন। হঠাৎ করেই বাতাস হালকা লাগতে শুরু করবে; তার আগ পর্যন্ত বাতাস যথেষ্ট ভারি। ইতিপূর্বে পরীক্ষাটা না করে থাকলে এরপরে সচেতনভাবে বোঝার চেষ্টা করিয়েন।
আমাদের ছেলেবেলায় মানিকগঞ্জ শহর নিয়ে মানুষের অন্তহীন অভিযোগ শুনতাম। ভালো কোনো রেস্টুরেন্ট নেই, ঈদের শপিং করতেও ঢাকায় যেতে হয়, ভালো ডাক্তার নেই, ৫ তলার উপরে বিল্ডিং নেই কারো; ঢাকা শহরের অন্যতম নিকটবর্তী জেলা হয়েও কেমন যেন গ্রাম্য আবহ; এর চাইতে বগুড়া কিংবা বরিশালের অনেক থানা সদরও অনেক উন্নত। এইসব অভিযোগকে কখনোই আমলে নেয়ার মতো কিছু মনে হয়নি। বরং এখানে-সেখানে খেলার মাঠ, উদীচি-সাবিস প্রভৃতি সংগঠনের সাংস্কৃতিক চর্চা, শিশু একাডেমির নিয়মিত ভিত্তিতে প্রতিযোগিতা আয়োজন, ফুটবল-ক্রিকেটের টুর্নামেন্ট, বেউথা নদী, তরার ব্রীজ, আরিচা-পাটূয়ারির ফেরিঘাট, হাইস্কুল-গার্লস স্কুলের রেজাল্ট নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীতা, কোন স্কুলের ফার্স্ট বয়-ফার্স্ট গার্ল এসএসসিতে স্ট্যান্ড করতে পারে সে সংক্রান্ত পূর্বানুমান, দেবেন্দ্র কলেজের ভিপি-জিএস কে হতে পারে, মানিকগঞ্জ থেকে কতজন নটরডেম, ঢাকা কলেজ কিংবা হলিক্রস, ভিকারুন্নিসায় ভর্তি হলো, কে কে মেডিকেল, বুয়েট, বা ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হলো এই সমস্ত গল্প শুনতে ভালো লাগতো।
প্রতি বছর ১৩ই ডিসেম্বর থেকে ২৭ শে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিজয়মেলা অনুষ্ঠিত হতো। দিনের বেলা জারিগান, কবিগান, বিচারগান চলতো; বিভিন্ন বয়াতিরা আসতো; উপস্থিত বক্তৃতা, নাটক, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা থাকতো, রাতের বেলা কোনো কোনোদিন ঢাকা থেকে শিল্পীরা গান গাইতে যেতো। দেবেন্দ্র কলেজের স্বপন নামের এক ছেলে মারামারির জেরে খুন হয়েছিলো, আর শুক্লা নামে বেউথার এক মেয়েকে এসিড নিক্ষেপ করে হত্যা করা হয়েছিলো- মানিকগঞ্জ ছাড়ার পূর্ব পর্যন্ত এই দুটো হত্যাকাণ্ড ছাড়া বড়ো কোনো নৃশংসতার গল্প শুনিনি। ছাত্রদল-ছাত্রলীগের মধ্যে ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া চলতো, কিন্তু সেটাও মারামারি পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিলো, খুনোখুনির কোনো ঘটনা ঘটেনি। সেওতা উদয়সেনা- ড্রাগন স্পোর্টিং ক্লাব- দাশড়া পল্লীমঙ্গল সমিতি- বেউথা মুকুল ফৌজ, এই ৪টা দলের ফুটবল খেলা থাকলে রেফারিং নিয়ে গেঞ্জাম বাঁধতোই, সেগুলোও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর্যায়ে যেতো না।
ক্রিকেট টুর্নামেন্টগুলোতেও কুলফা গোষ্ঠী, জোভাত সংঘ, প্রভাত সংঘ, বন্ধু একাদশ, বিল্টু ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, ডায়মন্ড স্পোর্টিং ক্লাব- এরা নিয়মিত অংশগ্রহণ তো করতোই আরিচা এবং ঘিওর থেকেও দল অংশ নিতো। দুর্জয় তখন জাতীয় দলের খেলোয়াড়, সে কুলফা গোষ্ঠীর হয়ে খেলতে আসবে শুনলে অনেক দর্শক আসতো; মানিকগঞ্জের আরেক ক্রিকেটার মোর্শেদ আলী খান সুমন মোহামেডানে খেলতো; আবাহনীতে খেলতে আসা ওয়াসিম আকরামকে বোল্ড করেছে সুমন ভাই, এই গল্প স্টেডিয়ামের আশপাশে গেলেই শোনা যেতো। শিপন, রোকন, সুজন, হালিম শাহ, শান্ত, দুলুসহ বহু ক্রিকেটার খেলতে যেতো।
তবে এগুলোর চাইতেও বেশি আকর্ষণ করেছিলো, শহরজুড়ে অনেকগুলো বইয়ের দোকান ছিলো। খান বুক হাউজের ডিউক ভাইয়ের কাছ থেকে ফ্রি কমিক্স পড়তাম। চাচা চৌধুরী, বিল্লু, পিংকি, টিনটিন সবই ছিলো তার দোকানে। এছাড়া গল্প-উপন্যাসের সংগ্রহও সমৃদ্ধ ছিলো। আরো বেশ কিছু লাইব্রেরি ছিলো- টাউন লাইব্রেরি, বিদ্যাসাগর লাইব্রেরি, পপি লাইব্রেরিসহ নাম না জানা আরও কত লাইব্রেরি। এইসকল লাইব্রেরির উপার্জনের বড়ো অংশই আসতো নোট-গাইড বই, টেস্ট পেপার প্রভৃতি বিক্রিসূত্রে।
তবে সবগুলো লাইব্রেরিতেই গল্প-উপন্যাস পাওয়া যেতো। ছাত্র-বন্ধু লাইব্রেরির মালিক যথেষ্ট বিদ্যানুরাগী ছিলেন। তার দোকানে ছিলো বইয়ের সংগ্রহ সবচাইতে বেশি। লাইব্রেরি ছিলো ২টি- একটি সরকারি, যেখানে ৮-১০টা দৈনিকপত্রিকা এবং অসংখ্য ম্যাগাজিন রাখা হতো, বড়োদের ভিড়ে পত্রিকা পড়ার সুযোগ মিলতো বিকালের দিকে, তবে ম্যাগাজিন পড়তে সমস্যা হতো না। বইয়ের সংগ্রহ মুগ্ধতা জাগানিয়া, দেবেন্দ্র কলেজের প্রচুরসংখ্যক ছেলে, কিছুসংখ্যক মেয়েকেও দেখতাম বই পড়তে এসেছে। লাইব্রেরিকেও মনে হতো বাজারের মতো সরগরম। আরেকটা ছিলো, বেসরকারি লাইব্রেরি; সেখানে পড়ার জন্য সদস্য হতে হতো। সাহেব আলি নামের জনৈক মুদি দোকানী একবার পাবলিক লাইব্রেরির নির্বাচনে দাঁড়ায়, এ নিয়ে বিস্তর সমালোচনা হলেও আমি ব্যাপারটাকে এভাবে দেখি- সেসময় বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তাচর্চার জোয়ার কতোটা বাঁধভাঙ্গা হলে একজন স্বল্পশিক্ষিত মুদি দোকানি পাবলিক লাইব্রেরির নির্বাচন করতে পারে।
মূল হাসপাতালের বাইরে ক্লিনিক ছিলো একটি- নিরাময় নার্সিং হোম। শুক্রবারে ঢাকা থেকে সেখানে ডাক্তার যেতো, যে কারণে শুক্রবারে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসতো। রিকশার বাইরে টেম্পু চলতো মূল শহর দিয়ে। বাস স্ট্যান্ড থেকে বেউথার রিকশাভাড়া ছিলো ১০ টাকা। দুটো সিনেমা হল ছিলো, টাউন হল আর নবীন সিনেমা হল। টাউন হলে নতুন সিনেমা বেশি আসতো, সন্ধ্যার শো তে প্রচুর মানুষ হতো। নবীন সিনেমায় সাধারণত একশন সিনেমা বেশি আনতো; সেখানে রিকশাওয়ালা আর বখাটেরা বেশি যায় এমন রিউমারের প্রেক্ষিতে নবীন হলে নারী দর্শকের উপস্থিতি তুলনামূলক কম থাকতো। এক পর্যায়ে টাউন হল বন্ধ হয়ে যায়, সেটা পরিবর্তিত হয় শিল্পকলা একাডেমিতে।
সাঈদ খান মজলিশ, পরেশ মালাকার প্রমুখ কোচ বিকাল হলেই কিশোর ক্রিকেটারদের নিয়ে মাঠে নেমে যেতেন। মামুন ভাই নামে একজন আবৃত্তিশিক্ষক ছিলেন, গোড় স্যার ছবি আঁকা শেখাতেন; রুস্তম আলী স্যার-মুস্তাফিজ স্যার-বরকতউল্লাহ স্যার ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন; গণিতের একচ্ছত্র কোনো শিক্ষক ছিলেন কিনা মনে নেই, তবে গনি স্যার-মনোরঞ্জন স্যারের নাম শুনতাম। আমরা নাইন-টেনে উঠতে উঠতে ইংরেজিতে মিজান স্যার, ইপসাইলন কোচিংয়ের চঞ্চল স্যার, গণিতে রতন স্যার, মঞ্জুর স্যার, শ্রীদাম স্যার প্রসিদ্ধি পান। গ্রেডিং সিস্টেম মাত্র চালু হচ্ছে সেসময়, অপশনাল সাবজেক্টের নম্বর গ্রেডিংয়ে যুক্ত হবে না, জিপিএ ৫ পেতে হলে সব বিষয়েই এ+ পেতে হবে- এই দুর্ভাবনায় বাংলা প্রাইভেট পড়ার হিড়িক লেগে যায়। মডেল স্কুলের দীপক স্যার, হাইস্কুলের সুরেশ স্যার বাংলা পড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যস্ত শিক্ষক হয়ে পড়েন।
অডিও ক্যাসেটের দোকান ছিলো অনেকগুলো। যে কোনো নতুন এলবাম বের হলেই দোকানগুলোতে সেই এলবামের গান বাজতো। ভিসিপি-ভিসিআর ছিলো আরেকটি বিনোদন মাধ্যম। আয়তাকার ভিডিও ক্যাসেট ছিলো, ১০টাকার বিনিময়ে সেটা ভাড়া নেয়া যেতো। কিছুদিন পরই ডিভিডি প্লেয়ার বাজারে চলে আসে, ভিসিপি-ভিসিআর মার্কেট আউট হয়ে যায়। ছবি তোলার জন্য কোডাক ক্যামেরার খুব কদর ছিলো, রিল কিনতে হতো, এক রিলে ৩৬টা ছবি তোলা যেতো, ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে কখনোবা ৩৭টা ছবিও হতো। তবে ক্যামেরা রাখা ছিলো অনেকটাই শৌখিন বিষয়, যে কারণে স্টুডিওগুলোরও বাজার ছিলো রমরমা। ছবি তোলার পাশাপাশি বিয়ের ভিডিও করা ছিলো তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিস।
ঢাকা-মানিকগঞ্জ যাতায়াত ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই একমাত্র শুভযাত্রা নামক এক বাসের উপর নির্ভর ছিলো। এছাড়া আরিচা থেকে ছেড়ে আসা ‘নবীনবরণ’ বাসেও গাবতলী পর্যন্ত যাওয়া যেতো।
মোবাইল ফোন তখনো আসেনি। প্রতি মহল্লায় ২-৩ বাসায় টিএন্ডটি ফোনের লাইন ছিলো; আশপাশের প্রতিবেশীরা তাদের যে কোনো প্রয়োজনে সেই বাসার ফোন নম্বর দিয়ে রাখতো। ফোন এলে তাদের খবর পাঠানো হতো। পোস্ট অফিসে প্রচুর চিঠি জমা পড়তো।
দেবেন্দ্র কলেজের সামনে খাল ছিলো একটা; ফলে শহীদ রফিক সড়ক থেকে দেবেন্দ্র কলেজে যেতে বাঁশের সেতুর উপর নির্ভর করতে হতো। একসময় সেতু সরিয়ে কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। স্টেডিয়ামের বাইরে বড়ো এক খেলার মাঠ ছিলো, যেটার মালিকানা ছিলো হাইস্কুলের। সেই মাঠের সাথেই খাল ছিলো একটা। কিছুদিনের মধ্যেই খাল কেটে ফেলা হয়। মাঠের চারধারে প্রচুর গাছ লাগানো হয়েছিলো, যেকারণে সন্ধ্যা লাগামাত্র বিভিন্ন বয়সের মানুষ মাঠে এসে বসতো, বাতাসে শীতল করতো শরীর।
দেবেন্দ্র কলেজের পেছনে যাওয়াকে দেখা হতো প্রেম করার লক্ষণ হিসেবে, যে কারণে কলেজের পেছনে যাওয়ার ক্ষেত্রে কিশোরদের প্রতি অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিলো। সুন্দর কোনো মেয়ে বা ছেলে উভয়কে নিয়েই প্রচুর গবেষণা চলতো। রাঙা, পিঙ্কি, সুরমা, টুটুল, রাজিব, সজীব চৌধুরী প্রমুখ নামগুলো কিংবদন্তীর পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো। ৯৫ সালে হাইস্কুল থেকে ৩ জন বোর্ড স্ট্যান্ড করেছিলো (সিয়াম মঞ্জেল, সঞ্জয়, বেনজির), ২০০১ এ গার্লস স্কুল থেকে মানিকগঞ্জের প্রথম জিপিএ ফাইভ পায় শেলী নামের একজন। এইসকল আলোচনা তখন সচেতন অভিভাবক, শিক্ষকদের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াতো। আমার ক্লাসের ফার্স্ট বয় রাতুল সরকারের বাবা-মা উভয়েই চিকিৎসক হওয়ায়, এবং ওর বাবা নিজে বাইকে চড়িয়ে ওকে স্কুলে আনা-নেয়ার কাজ করায় ওকে ঘিরে অজস্র মিথ বা গল্পের সৃষ্টি হয়েছিলো। একজন খুব নামকরা নৃত্যশিল্পী ছিলেন, যিনি জাপানে নাচতে গিয়েছিলেন। সেই আপুটার নাম মনে নেই এই মুহূর্তে; লুলু-লুনা এধরনের কিছু একটা হবে। তসলিম হৃদয় নামের এক তরুণ কবিতা আবৃত্তির ক্যাসেট বের করেছিলো, অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেও তার সম্পৃক্ততা লক্ষ্য করা যেতো। প্রতিভার নিদারুণ ঘাটতি থাকলেও তার অধ্যবসায়ের গুণ অপরিসীম ছিলো সেসময়।
এতো দীর্ঘ বক্তব্য বা রিপোর্টিংয়ের মধ্য দিয়ে মূলত একটা শান্তিপ্রিয় এবং সংস্কৃতমনস্ক উপশহরের দৃশ্যপট-প্রেক্ষাপট বিশদভাবে ধারণ ও উপস্থাপনের চেষ্টা করা, যাকে ২০০৩ এ ছেড়ে এসেছি, এবং ফিনল্যান্ড বা ডেনমার্কে চলে না গেলে ২০২৩ অথবা ২০২৯ এ পুনরায় প্রত্যাবর্তন করতে চাই।
বর্ণনাগুলো মনোযোগ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করলে এক লাইনে মনোভাব ব্যক্ত করা যায়- জীবনে গতি বা গ্ল্যামার নেই, কিন্তু পারস্পরিক যোগাযোগ, চিন্তাচর্চা আর সাংস্কৃতিক বিকাশের অপরূপ পরিবেশ বিদ্যমান। ঢাকাকে যদি চূড়ান্ত গন্তব্য বা জীবিকাকেন্দ্র ধরি, মানিকগঞ্জের উপশহরকে বলা যায় বীজতলা তৈরির নার্সারি। মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ, প্রজ্ঞা এবং অন্তর্দৃষ্টি গঠনে যে অনুকূল ইকোসিস্টেমটা দরকার, ২০০৩ পূর্ব মানিকগঞ্জকে তার সার্থক মডেল বলতে পারি। তবে এই বক্তব্য দেয়ার পর এখনকার প্রজন্মের কতিপয় মানুষ অবলীলায় একে ‘যায় দিন ভালো, আসে দিন খারাপ’ থিওরিতে ফেলে দিতে পারে। আমাদের আগের প্রজন্মের মানুষেরা হয়তোবা আমার দেখা মানিকগঞ্জকে অধোঃপতিত উপশহর হিসেবে দেখবে; এভাবে দেখতে গেলে সবসময়ই ‘those were the days’ এর আফিমে বুঁদ হয়ে থাকতে হবে। একারণেই সুনির্দিষ্ট কিছু প্যারামিটার রাখতে চাই যাতে ‘পল্লীশোভিত উপশহর’ আবহটা ব্যাখ্যা করা যায়, এবং সেটা কালনিরপেক্ষ হয়।
বিগত ১৮ বছরে পৃথিবী যতটুকু বদল হয়েছে সমপরিমাণ বদল হতে পূর্বের পৃথিবীর নিদেনপক্ষে ২৫৭ বছর লেগেছে। বিশ্বপরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে পড়বে এটাই চিরঅনুমিত। সেই পরিবর্তনের প্রধান প্রদর্শক হবে ঢাকা, অন্য শহরগুলো তাকে অনুসরণ করবে মাত্র। ফলে ১৫ বছর আগে যে মানিকগঞ্জ শহরকে রেখে এসেছিলাম, এখনকার মানিকগঞ্জ যে তার সাথে মিলবে না একদমই না এটা মানতে খারাপ লাগে না মোটেই। বিশ্বায়ন বলতে আমি ‘সেন্ট্রালড কন্ট্রোল মেকানিজম’ বুঝি, যার বদৌলতে মেক্সিকোর রেস্টুরেন্টে অতর্কিত গোলাগুলি হলে তার প্রভাব পড়বে মানিকগঞ্জ জেলার ঠাকুরকান্দি নামক প্রত্যন্ত গ্রামের জনৈক আব্দুল নামের চাষীর জীবনযাপনেও। আদতেও হচ্ছে তাই।
‘সোনার হরিণ’ উপমাটা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আদতে কী বুঝিয়েছিলেন সেটা তিনিই ভালো বলতে পারবেন, তবে আমি সোনার হরিণকে বরাবরই ‘সাকসেস, স্ট্যাটাস এবং শো-অফ’ এর সংমিশ্রণ হিসেবে দেখেছি। গ্লোবাল পলিটিকাল মোডিউলটা এমনভাবে ডিজাইন করা যেখানে সোনার হরিণের মোহ ত্যাগ করাকে ঔদাসীন্য, ইমপ্র্যাকটিকাল কিংবা ইম্যাচিউরিটি হিসেবে বিবেচনা করা হবে।
কিছুদিন আগে, ভোরবেলা চন্দ্রিমা উদ্যানে বৃষ্টির মধ্যেও নটরডেমের এক সিনিয়র ভাইয়ের সাথে দাবা খেলি। এরকম ভোরে চন্দ্রিমা উদ্যানের মতো জায়গায় ২জন মানুষ দাবা খেলতে পারে, এটাকে পাগলামি হিসেবেই দেখেছে অনেকে। সেই সিনিয়র ভাই দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত আছেন। দাবা খেলা শেষে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে হাঁটতে হাঁটতে যখন সকালের নাস্তা করছিলাম একসাথে, সেই ভাই আমার হিউম্যানল্যাব৭৭৭ সম্বন্ধে জেনে বললেন, আপনার প্রতিষ্ঠানে কি ‘হ্যাপিনেস’ বাড়ানোর কোনো সার্ভিস আছে? এটা যদি দিতে পারেন, বহু মানুষ উপকৃত হবে। সবাই সাকসেসের পেছনে ছুটছে, কারণ তারা ধারণা করেছে সফল হতে হলে প্রচুর টাকা উপার্জন করতে হবে , কিংবা খ্যাতিমান হতে হবে; তাতেই জীবনের সুখ নিহিত। কিন্তু যখন টাকা-খ্যাতি দুটোই পেয়ে যায় তবু দেখে হ্যাপিনেস নেই; গ্যাপটা কোথায়- এটা যদি বের করতে পারেন হিউম্যানল্যাব বড়ো কন্ট্রিবিউশন রাখতে পারবে!
সিএনজিযোগে যখন ফিরছিলাম, পুরোপথ তার ওই প্রশ্নটাই মাথায় ঘুরছিলো –‘হ্যাপিনেস সার্ভিস কি দেয়া সম্ভব’? এবং তখনই ১৫ বছর আগে রেখে আসা ‘চিন্তাবিকাশ কেন্দ্র’ তথা উপশহর মানিকগঞ্জকে মনে পড়ে, এবং অনুসিদ্ধান্তে আসি হ্যাপিনেস একটি ওভাররেটেড চিন্তা এখনকার বিশ্বব্যবস্থায়, হয়তোবা অতীতেও ছিলো, কিন্তু এখনকার সময়ে ওভাররেটিংয়ের প্রসঙ্গটা অনেক বেশি বাস্তব। চাহিদা, প্রত্যাশা দুটোই যখন আকাশচুম্বী তখন সেখানে সোনার হরিণের বাইরে যে কোনো আলোচনাই খাজুরে আলাপের নামান্তর। এমনকি ভূটানে যে জিডিপির পরিবর্তে হ্যাপিনেস ইনডেক্সের উপর জোর দেয়া হয়, একেও এক ধরনের পলিটিক্যাল স্ট্যান্টবাজি মনে হয়। ফলে হ্যাপিনেস আদৌ কি দরকার মানুষের? যে আশরীর চাহিদা-প্রত্যাশার রাশিয়ার মানচিত্র হয়ে আছে তাকে হ্যাপিনেসের গল্প শুনিয়ে ফায়দা কী? যে ব্যক্তি মিনিটে মিনেটে চেক ইন দেয়, সেলফি না তুললে অস্থির লাগে যার, এফডিআর, সঞ্চয়পত্র, ক্রেডিট কার্ড, ফ্ল্যাট বুকিং, কিংবা কলিগ বা পরস্ত্রীর সাথে ফ্লার্ট করায় ব্যতিব্যস্ত, সে তো এসবেই হ্যাপিনেস খুঁজে নিতে চাচ্ছে। সে খুঁজে পাবে না নিশ্চিত, না পেলে সে সীসা লাউঞ্জে গিয়ে সীসা খাক, দামী গেজেট কিনুক; হ্যাপিনেসের সাথে দেখা করার সংগ্রামটা তাকেই নিতে দিই না কেন! ‘ফুল টাইম সুখীমানুষ’ এটাও হয়তোবা একপ্রকারের পলায়নবৃত্তি।
ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জে যাওয়ার সময় থেকেই চমকে যাওয়ার শুরু হয়। শুভযাত্রার পাশাপাশি ভিলেজ লাইন, পদ্মালাইন বাস নেমেছে, নীলাচল নামে বাস এসেছে; এমনকি এসি বাস সার্ভিসও চালু হয়েছে। বাস স্ট্যান্ডে যখন বাস থেকে নামি, নতুন মার্কেট দেখি, অনেকগুলো খাবারের হোটেল দেখি, অদূরে দেখি মমতাজ চক্ষু হাসপাতাল, আশপাশে অগণিত ডায়াগনস্টিক সেন্টার; রাস্তা আরো প্রশস্ত হচ্ছে, নতুন একটি মেডিকেল কলেজ যুক্ত হয়েছে। তরা-গিলণ্ডোতে স্থাপিত হয়েছে মুন্নু মেডিকেল হাসপাতাল। বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসায় যাওয়ার সময় রিকশা চোখে পড়ে কদাচিত; শহর ছেয়ে গেছে ব্যাটারিচালিত হ্যালো বাইকে, রিকশা যা আছে সেগুলোও ব্যাটারিচালিত। বাসস্ট্যান্ডে অধীর অপেক্ষায় থাকি মনুষ্যচালিত রিকশার জন্য। পরিচ্ছন্ন শহরের আকাশে উড়ে রাশিরাশি ধূলি-বালি; রাস্তা খোঁড়াখুড়ি আর একের পর এক কনস্ট্রাকশনের কাজ। পুরনো বাড়িগুলো ডেভেলপার কোম্পানীরা নিয়ে নিচ্ছে, সেখানে নির্মিত হচ্ছে সুউচ্চ টাওয়ার, চলছে ফ্ল্যাটবুকিং, ২০১৩ এর পরে জমির দাম কমে গেছে অনেকখানি, তবু জমি কেনার চাইতে রেডিমেট ফ্ল্যাট কেনায় মানুষের আগ্রহ বেশি। যারা ইতিমধ্যে জমি কিনেছে তারা বিল্ডিং নির্মাণে হাত দিয়েছে; আমার মাও চিন্তা করছেন পুরনো দোচলা ঘর ভেঙ্গে বিল্ডিং নির্মাণের।
আমি বাসায় আসার পথে যতগুলো নির্মীয়মাণ বিল্ডিং দেখি, কিংবা বাইরে হাঁটতে বেরুলে যেসব কনস্ট্রাকশন দেখি, মানুষের কাছে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে চাই। দেখি, দৌলতপুর-শিবালয়-সিংজুড়ি-বৈকুণ্ঠপুর-হরিরামপুর-সাটুরিয়া-ঘিওর-তেরশ্রীর মানুষেরা মানিকগঞ্জ শহরে আবাসন নিচ্ছে। অন্যদিকে মানিকগঞ্জ শহরের তুলনামূলক ধনিক গোষ্ঠীদের বড়ো অংশেরই ঢাকায় ফ্ল্যাট কেনা, কিংবা চাকরিসূত্রে তারা ঢাকায় স্থায়ী হয়ে পড়ছে। গ্রামে থাকা আমার মামাও মানিতগঞ্জে জমি কিনেছেন, হয়তোবা ভবিষ্যতে তিনিও গ্রাম ছেড়ে শহুরে নাগরিক হবেন। এটা ভাবতে গিয়ে মাথায় আসে, সর্বশেষ কয়েক বছরে দেশ ছাড়ার সংখ্যা ব্যাপকহারে বেড়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় তো যাচ্ছেই স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতেও পাড়ি জমাচ্ছে মানুষ, তাদের উত্তরসূরীরা দেশ হিসেবে জানলে সেগুলোকেও। ঔপনিবেশিক কারণে লন্ডনে যাওয়ার হার আগে থেকেই অনেক বেশি ছিলো
এই পরিসংখ্যান দেখি, আর বসুন্ধরা শপিংমলের লিফট দিয়ে যখন ঊর্ধ্বগামী হই, অদ্ভুত এক কোরিলেশন আবিষ্কার করি। গ্রাম থেকে উপশহর, উপশহর থেকে রাজধানী, সেখান থেকে প্রবাস- এই যে লিফটযোগে ঊর্ধ্বারোহণ, এর সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক গবেষণার যোগসূত্র পাই। আফ্রিকা মহাদেশ থেকে মানুষের যে পূর্বপুরুষেরা মধ্যপ্রাচ্য অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিলো লক্ষ বছর আগে, সেই যাত্রা তো এখনো চলমান। এবং সভ্যতার উৎকর্ষের যেসব প্যারামিটার নির্ধারণ করি আমরা, তার লেভেল অব এক্সিলেন্সের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমরা। তারপর কী হবে? কোনো মহাপ্রলয়, যার মাধ্যমে পৃথিবীর বৃহত্তর একটি জনগোষ্ঠী বিলীন হয়ে যাবে; নূহের মহাপ্লাবনে যেরকম কিছু প্রাণী রক্ষা পেয়েছিলো, সেরকম কিছু মানুষ হয়তোবা টিকে যাবে; তারপর সেখান থেকে শুরু হবে নতুন সভ্যতার যাত্রা। মানুষ এক মহাজাগতিক লুপে আটকে পড়েছে, যেখানে চক্রাকারে ঘূর্ণায়মান থাকাই নিয়তি তার। একারণেই হয়তোবা আমাদের জীবন পুনরাবৃত্তি বা রিপিটেশনের ছন্দে আবদ্ধ।
মানিকগঞ্জ শহরকে আরো পর্যবেক্ষণ করি। নবীন সিনেমা হলের অবস্থা পরিত্যক্ত বাড়ির মতো; তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে চটপটি, ফাস্টফুডের দোকান। দেবেন্দ্র কলেজের উন্মুক্ততা খাঁচায় আবদ্ধ; পুরনো কৃষ্ণচূড়া গাছ কাটা পড়েছে; পাঁচিল তুলে কলেজ প্রাঙ্গন বানানো হয়েছে নিশ্ছিদ্র; পথে-ঘাঁটে ছাত্রনেতাদের বিরাট ব্যানার, যেটা দেখে বোঝার উপায় নেই কার পক্ষ থেকে কে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। আমাদের কৈশোরে মাঠের দখল নিতে আগেভাগে খেলা শুরু করতে হতো; এখন মাঠ প্রায় খালিই পড়ে থাকে, ক্রিকেট-ফুটবল খেলার জন্য ২-৩টা বাচ্চা ব্যতিরেকে সেভাবে দেখিই না। হাইস্কুলের মাঠটি সারাবছর রাজনৈতিক অনুষ্ঠানেই ব্যবহৃত হয়, খেলাধুলার নাম-গন্ধ নেই, সেখানে জনৈক চটপটিওয়ালা চেয়ারের পর চেয়ার সাজিয়ে চটপটিশালা বানিয়ে রেখেছে, সেই মাঠেও দেয়াল তুলে বাউন্ডারি দেয়া হয়েছে, মাঠের পাশেই গড়ে উঠেছে নব্য বাসস্ট্যান্ড।
এককালে কোনো ফাস্টফুডের দোকান নেই বলে যারা হাহুতাশ করতেন, তারাই এখন প্রশ্ন তোলেন এতো রেস্টুরেন্ট কেন? মূল শহরে, নদীর ধারে, এপাড়ায়-সেপাড়ায় একের পর এক রেস্টুরেন্ট চালু হচ্ছেই। তৃপ্তি প্লাজার ছোট্ট পরিসরই ছিলো একসময়ের শপিংকেন্দ্র; শহরজুড়ে জামা-কাপড়ের দোকান কিলবিল করে পোকার মতো। পার্লারের সংখ্যাও বেড়েছে বিস্তর। লাইব্রেরি তেমন একটা চোখেই পড়ে না, ফার্মেসির সংখ্যা বেড়েছে মিনিমাম ৩গুণ। এই দৃশ্যপটটা খুবই ইন্টারেস্টিং। পাবলিক লাইব্রেরি বলতে গেলে ফাঁকাই পড়ে থাকে, রেস্টুরেন্টগুলোতে সন্ধ্যার দিকে জায়গা পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে, পার্লারে যাওয়া মেয়েরাও লাইনে অপেক্ষমান থাকে; অথচ ওষুধ বিক্রির সংখ্যা বেড়েছে বহুগুণ। ওষুধ তো কেউ শখ করে সেবন করে না। ওষুধ বিক্রি বাড়লো কেন?
আমাদের স্কুলটাও বাউন্ডারিবদ্ধ। শুনেছি সেখানে ২ শিফট চালু হয়েছে। গার্ল স্কুলের অবস্থাও অনুরূপ। মডেল স্কুলের খবর জানি না অবশ্য। এবং মজার ব্যাপার হলো, কেবলমাত্র হাইস্কুল-গার্লস স্কুলে চান্স পাওয়ানোর উদ্দেশ্যেই শহরজুড়ে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো কোচিং সেন্টার। তবুও চান্স পাবে কিনা নিশ্চিত না। বাড়ি ভাড়া নিয়ে এখানে-ওখানে গজিয়ে উঠেছে কিন্ডার গার্টেন, ছাত্র-ছাত্রী আর আগত মায়েদের সংখ্যা প্রায় সমান সেখানে। এটা কি জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলাফল? জানি না, তবে ইমব্যালেন্স তো আছেই।
এতোসব স্থাপনা দেখলে সহজেই বোধগম্য হয়, নব্যধনিক শ্রেণীর উদ্ভব ঘটেছে। বিশেষত পুরো মানিকগঞ্জ শহর যেখানে মাত্র ৫০ টাকা রিকশাভাড়া দিয়েই ঘুরে ফেলা যায়, সেখানে গাড়িধারী মানুষের সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বছরে তারা কতবার ঢাকায় আসেন হয়তোবা নিজেরাও জানেন না, তবু গাড়ি না থাকলে ধনিক শ্রেণিতে বিলং করা যায় না। হয়তোবা গ্যারেজবন্দী অবস্থাতেই নিঃশেষিত হয় গাড়ির জীবন-যৌবন, তবু বাজার করতে ৫-১০ মিনিটের পথ যেতেও গাড়ি না হাঁকালে চলে না।
তখন প্রশ্ন আসে মনে, মানুষের এতো টাকার উৎস কী? তাদের পেশাই বা কী? কেউ ঠিকাদারি করে, রড-সিমেন্টের ব্যবসা করে, কেউবা বড়ো কোম্পানীর ডিলারশিপ নিয়েছে, কেউবা রাজনৈতিক পরিচয় ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন সেটলমেন্ট করে। ফলে টাকাগুলো একটি নির্দিষ্ট চ্যানেলেই রোলিং করছে মাত্র। একসময় সোনালি ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংকের বাইরে তেমন কোনো ব্যাংকের অস্তিত্বই ছিলো না; এখন দেশের নামকরা বেশিরভাগ বেসরকারি ব্যাংকের ব্রাঞ্চ আছে মানিকগঞ্জে। অন্য কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেভাবে চোখে পড়েনি, হাইওয়েতে কয়েকটা ফ্যাক্টরি গড়ে উঠেছে। এতোগুলো ব্যাংক ব্রাঞ্চ দিয়ে রেখেছে কেন, সেটা দেখেও কি বোঝা যায় না কিছু মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতা কোন্ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে? সেই কিছু মানুষ’শ্রেণিটিই মূলত অদৃশ্য সমাজপতি হয়ে উঠেছে। মূল্যবোধ, এথিক্স এগুলো তাই বইয়ের পাতায় লেখা থাকে, প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সংজ্ঞাগুলো নিজেদের সুবিধাজনক ভাষায় ইন্টারপ্রেট করে নিতে পারি আমরা।
আমাদের ছেলেবেলায় প্রায় প্রত্যেক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাড়িতেই গৃহপরিচারিকা থাকতো; সেই পরিবারের বাচ্চা-কাচ্চাগুলোর জীবনে গৃহপরিচারিকাদের অবদান থাকতো, তারা হয়ে উঠতো পরিবারেরই অংশ। ১৫-২০ বছর ধরে একই বাড়িতে কাজ করছে এমন দৃষ্টান্তও পাওয়া যেতো। তুলনামূলক উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোতে একাধিক পরিচারিকা থাকতো। কিন্তু এই শ্রেণিটি এখন বিলুপ্তপ্রায়। গার্মেন্টসের বিকাশে কারো বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকার চাইতে স্বাধীনভাবে উপার্জন করাটাই শ্রমজীবী শ্রেণীটির কাছে প্রাধান্য পাচ্ছে। বহুবছর আগে হুমায়ূন আহমেদ একটি নাটক নির্মাণ করেছিলেন যেখানে আসাদুজ্জামান নূর একটি কোম্পানী খুলেন বুয়া সাপ্লাই দেয়ার, কোম্পানীর নাম ছিলো সম্ভবত গৃহসুখ প্রাইভেট লিমিটেড। প্রায় ১৭-১৮ বছর আগের নাটক হলেও, হুমায়ূন আহমেদ কতখানি দূরদর্শী ছিলেন এই নাটক তা আবারো প্রমাণ করে।
গৃহপরিচারিকা শ্রেণি বিলুপ্ত হওয়ায় কি উপকার হলো, নাকি দায়মুক্তি হলো সেই আলোচনা এই লেখায় অপ্রাসঙ্গিক। তবে জমজশিশু উনিশ,তেইশকে নিয়ে আমার সহমানুষ আরিফা যখন একাকী সংগ্রাম করে তখন প্রায়ই ভাবি কাজের বুয়া চেয়ে ফেসবুকে পোস্ট লিখবো কিনা। এরকম আরিফা নিশ্চয়ই দেশজুড়ে আরো অনেকেই আছে। তাদের ক্রাইসিসটা তো আরোপিত নয়। গার্মেন্টস বনাম গৃহ, দুটো ভবিষ্যতে কম্পিটিটিভ ইন্ডাস্ট্রি হবে হয়তোবা। গৃহপরিচারিকার সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, ইনসেনটিভ, এন্টারটেইনমেন্ট, প্রোভিডেন্ট ফান্ড প্রভৃতি প্যাকেজ নিশ্চিত করে ‘গৃহ’ যদি কোনোদিন অর্গানাইজড সেক্টর হতে পারে, তখন হয়তোবা গৃহপরিচারিকা শ্র্রেণির পুনর্জাগরণ ঘটবে।
হঠাৎ করে বিপুল বিক্রমে বেড়েছে বাইকচালকের সংখ্যা। স্কুল-কলেজে পড়া কিশোরও শহরজুড়ে প্রচণ্ড গতিতে বাইক দাবড়িয়ে বেড়ায়। সেগুলো মোটেই পুরনো মডেলের বাইক নয়, রেসিং স্টাইলের বাইক। সেভেন-এইটে পড়া অনেক ছেলে-মেয়ের হাতেই দামী স্মার্টফোন। আমার খুব ইচ্ছা করে, এইসকল কিশোর-কিশোরীর মা-বাবার ইন্টারভিউ নিতে; ঠিক কোন্ চিন্তাধারা থেকে তারা এই কাজগুলো করছেন?
গতবছর ডিসেম্বরে আমি একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম। আমার স্কুল এবং পার্শ্ববর্তী গার্লস স্কুল থেকে ১জন ছেলে, ১ জন মেয়ের প্রত্যেককে প্রতিমাসে ১৭০০ টাকা বৃত্তি দিবো। প্রকল্পের নাম ছিলো ‘অন্তর্দৃষ্টি নির্মাণ প্রকল্প’। এর জন্য আমি ৬টি শর্ত আরোপ করেছিলাম
. যে ২টার বেশি প্রাইভেট পড়ে না
. স্যারের সহায়তা ছাড়াই যে বইয়ের ৩৭% ম্যাথ নিজে করতে পারে অথবা ফ্রি হ্যান্ডে প্যারাগ্রাফ লিখতে পারে
. যে কারণে-অকারণে প্রচুর প্রশ্ন করে
. যে কোনো না কোনো সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িত, তবু কোনো সাবজেক্টে ফেল না করেই পরের ক্লাসে প্রমোশন পায়
. পাঠ্যপুস্তকের বাইরে যে প্রতিমাসে অন্তত ১টা বই পড়ে
. যে স্মার্টফোন ব্যবহার করে না
এই ৬টি শর্তের মাত্র ৩টি পূরণ করলেই সে বৃত্তির জন্য আবেদন করতে পারবে, এটাই ছিলো প্রস্তাব। কোনো বইয়ের সহায়তা ব্যতিরেকে সম্পূর্ণ নিজের ভাষায় ‘আমার জীবনের লক্ষ্য’ রচনা লিখে পাঠাতে হতো। তার মধ্য থেকে যাচাই করে মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে ২ জনকে নির্বাচিত করার পরিকল্পনা ছিলো। ১ বছর ধরে আমি প্রতিমাসে ওই কিশোর-কিশোরীকে সুনির্দিষ্ট কিছু এসাইনমেন্ট দিতাম, এবং পরীক্ষার মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করতাম একই রকম সুযোগ-সুবিধা পেলে সমবয়সী একজন কিশোর আর কিশোরীর অন্তর্দৃষ্টি প্রক্রিয়া কেমন হয়, এবং এটা কীভাবে তাদের মধ্যে ইমপ্যাক্ট তৈরি করে।
কিন্তু ১ বছর পেরিয়ে গেলেও কাঙ্ক্ষিত ২ জন মানুষ পাইনি আমি। হাইস্কুল থেকে ৫জন আবেদন করেছিলো (যারা মাত্র ২টি শর্ত পূরণ করে), গার্লস স্কুল থেকে ১জনও নয়। এই যদি হয় অবস্থা, সেই শহরের কাছে প্রত্যাশা কতটুকু হওয়া উচিত, বা আদৌ কি প্রত্যাশা বলতে কিছু প্রাপ্য বা প্রযোজ্য?
শুরুতেই বলেছি, মানিকগঞ্জ একটি স্যাম্পলমাত্র। হয়তোবা প্রতিটি জেলাশহরের বর্ণনা বা বিবর্তনটাই এরকম। লাইব্রেরি নেই, মিউজিয়াম নেই, সংগঠনগুলো মৃতপ্রায়, স্কাউটিংয়ের চর্চা স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে, ভোরে উঠেই কোচিং বা টিউটরের বাড়ি ছুটতে হচ্ছে, ফেরার পর আবার কোচিং। ঢাকাকে সেই ২০১২ সাল থেকেই মৃতনগরী মনে হয় আমার; মফঃস্বলগুলোও ঢাকা হতে গিয়ে প্রাণবন্ততা বিকিয়ে দিচ্ছে; সম্পদের বণ্টন যখন এরকম চরম একমুখী এবং ত্রুটিপূর্ণ হবে, সেখানে পাখির কলরব থাকবে না, আনাচে-কানাচে গড়ে উঠা বাহারি নামের রেস্টুরেন্টের নিয়ন বাতিগুলোই চোখ ঝলসে দিবে শুধু। আমরা চোখ ঝলসানো আলোতে চিলি-চিকেন খেয়ে উড়ন্ত চিলের পেছনে দৌড় দিবো, পারলে উড়াল দিবো, তবু চিল ধরতেই হবে।
একারণে মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে নামলে সাময়িক দিগভ্রান্ত হই; ভাবি, এটা কি মিরপুর ডিওএইচএস, নাকি মুগদাপাড়া? এটাই যে মানিকগঞ্জ তার প্রমাণ কী। প্রমাণ খোঁজার বাহানায় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকি, কিন্তু প্রমাণ আর পাই না। একসময় রিকশায় উঠে বাসার গন্তব্যে ছুটি, আর গুনগুন করতে থাকি
শোনরে হৃদয়হীনা
তোকে আর ভাবি না
উড়ে যায় এ বুক ছেড়ে।
প্রতারনার আগুন জ্বালিয়ে চলে গেলি
মনের আকাশ জুড়ে।
সে আগুন দিয়ে আজ তোর পৃথিবী
জ্বালিয়ে করবো ছারখার
বুঝলি না তুই
What is Love, What is Love!!!
রিকশা থেকে নেমে যখন বাসার গেটে ঢুকি, তখন আমি নয়, ১৫ বছর আগের কোনো কিশোর মাঠ থেকে ক্রিকেট খেলা শেষে ব্যাটবল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। আমি কিশোরকে চিনি, অথচ চিনি না, কেবলাকান্তের মতো কেবল চিল আর চিলির ব্যবধান আবিষ্কারের ভনিতা দেখাই। বাসযোগ্য পৃথিবীর নকশা কেমন এ সংক্রান্ত এক ফিলোসফিকাল আলোচনার জন্য কোনো আর্কিটেক্টকে সন্ধান করতে থাকি মনে মনে। শেষপর্যন্ত মাথায় চিলই ফেরত আসে, ছোঁ মেরে আমাকে তুলে নিয়ে উড়াল দেয় জোনাকিপোকার উদ্দেশে! আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচি…..