আগামীকাল ৩০ এর কোটায় প্রবেশ করবো আমি। নতুন একটি দশকের শুরু হবে। জীবনের গল্পটাকে একটা সিনেমা ধরলে ৩০ বছরকে বলা যেতে পারে তার ইন্টারভ্যাল। এই জার্নিটা কীভাবে গেল তার একটা রিক্যাপ করা যেতে পারে।
গল্প বলার মতো কোনো শৈশব আমার ছিলো না। একদমই সাদামাটা। শৈশবের প্রায় পুরোটাই মা-ভাই-বোন, আলাদা করে বড় বোন। আমার সমগ্র জীবনেই বড় বোনের প্রভাব বয়ে বেড়াচ্ছি। প্রাথমিক শৈশবে দুরন্ত প্রকৃতির ছিলাম, তবে তা ঘরোয়া পর্যায়ে, বাইরে বরাবরই চুপচাপ। বন্ধু কিছু হয়েছিল, সবই ক্রিকেট খেলাসূত্রে। একটা সময় গেছে যখন প্রায় প্রতিদিনই নতুন টেনিস বল আর টেপ কিনতে হয়েছে।
শৈশবে এচিভমেন্ট বলতে নিজের একটা বিশেষ দক্ষতা আবিষ্কার, যে কোনো সংখ্যা ক্যালকুলেটর ছাড়া মুখে মুখেই গুণন করতে পারি। এটা আবিষ্কারের পর দেখলাম আশপাশের কারো মধ্যে এই ক্ষমতা নেই। নিজেকে বিশেষ কিছু ভাবার যে ভুলটা বাচ্চারা করে সেই ভুলের ফাঁদে আমিও জড়িয়ে পড়ি। একই সময়ে টুকটাক ছড়া-কবিতা লেখার দরুণ এই ভুলের সীমানা আরও বড় হতে থাকে। মনীষীদের জীবনী পড়ার কারণে নিজের মধ্যে একটা ক্রেভিং তৈরি হয়েছিল আমাকেও মনীষী হতে হবে, এই ক্রেভিংয়ের মধ্যে যে সোশ্যাল এবং পলিটিক্যাল পারসপেকটিভ এর বিশাল একটা ফাঁক আছে সেটা বুঝতে আমার ২৭ বছর সময় লেগেছে। ‘আই এ্যাম ডিফারেন্ট ফ্রম আদারস’- এই ফিলিং একজন মানুষকে তার সময় ও সময়ের মানুষ থেকে অনেক দূরে ঠেলে দেয়, সে বসবাস করে বিচ্ছিন্নতার এক বিকট গ্যালাক্সিতে। কলেজে পড়তে ঢাকায় আসার পর নিজের সত্যিকারের অবস্থানটা বুঝতে পারি। গড়পড়তা মেধার মানুষেরা যে কমপ্লেক্সিটিতে ভুগে, আমার শৈশব, এবং কৈশোরের একটা দীর্ঘ সময় সেই কমপ্লেক্স এ কেটেছে। মিডিওকার হওয়া দোষের নয়, কিন্তু মিডিওক্রিটি মানতে না চাওয়াটা দোষের। আমি একজন মিডিওকার মানুষ, এটা যতদিনে মেনে নিয়েছি, ততদিনে বেলা অনেকটা বয়ে গেছে।

তুলনায় আমার কৈশোর যথেষ্ট বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং ব্যালেন্সড। এ মাঠে- সে মাঠে দাপিয়ে ক্রিকেট খেলে বেড়ানো যেমন আছে, একই সাথে চেয়ার-টেবিলের সাথে নিজেকে দড়ি দিয়ে বেঁধে ১৩-১৪ ঘণ্টা পড়াশোনাও আছে। চা এর প্রতি আসক্তির সূচনাও এই সময়ে। এই আসক্তি অক্ষুণ্ন ছিলো প্রায় ১৪-১৫ বছর, ভার্সিটি লাইফে ২ হাতে ২ কাপ চা একত্রে খাওয়ার ট্রেন্ডও চালু করেছিলাম। সর্বশেষ ২ বছরে স্বাস্থ্যজনিত কারণে চা আসক্তি কমে গেছে, এমনকি যতটুকুই চা খাই সেটা চিনি ছাড়া রং চা।
কৈশোরে পরিবারের বলয় ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে বন্ধু খুঁজে নিয়েছি (যাদের সাথে এখনো প্রথম দিনের মতোই ঘনিষ্ঠতা), প্রচুর রচনা প্রতিযোগিতা করেছি, নিজে কুইজ কনটেস্ট আয়োজন করেছি। তবে এসবের চেয়েও সিগনিফিক্যান্ট যে কাজটা করেছি তা হলো মানুষের সাক্ষাৎকার নেয়া। সাক্ষাৎকার নেয়ার সেই যে মোহ সৃষ্টি হয়েছে সেখান থেকে আর মুক্তি পেলাম না, এখনো তা অটুট রয়েছে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সদস্য হওয়া, সেই আদলে নিজেই একটা লাইব্রেরি গড়ে তোলা (ইস্টার্ন মডার্ন লিটারেচার সেন্টার বা ইএমএলসি, এর একটা সীলও বানিয়েছিলাম সেসময়) আমার কৈশোরের কনটেন্ট তালিকায় অনবদ্য সংযোজন। আরেকটা শখ পেয়ে বসেছিল যা আমি কখনোই স্বীকার করিনি, সেটা হলো গান গাওয়া। গান গাইতে ভালো লাগতো, বুয়েটে ২টা প্রোগ্রামে ব্যাকস্টেজ থেকে গান গাওয়া হয়েছিলো। অতিরিক্ত লাজুক প্রকৃতির হওয়ায় গান গাওয়াটাকে সিরিয়াসলি নেয়ার কথা চিন্তাই করতে পারিনি, তাছাড়া গানে বিশেষ প্রতিভাও ছিলো না কখনো। তার বদলে গান লেখা শুরু করি, তবে গান গাওয়া বা লেখা কোনোটার প্রতিই কখনো আকর্ষণ বোধ করতে পারিনি।

কলেজ জীবন আমার জন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়। সময় যেন থমকে গিয়েছিল দুই বছরের জন্য, অর্জন কিছুই নেই, কিন্তু বিসর্জন বিস্তর। সেই সময়টাতে অনুধাবন করি আমি সাইন্স বুঝি না, ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রি যে বুঝার জিনিস এটা আগে কখনো ভাবিইনি। ইন্টার পরীক্ষা দেয়ার পর প্ল্যান করি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনশিপ বা জার্নালিজমে পড়বো, বড় আপার সাথে হালকাচালে বিষয়টা শেয়ারও করি, কিন্তু তার তীব্র আপত্তিতে প্ল্যানটা নিয়ে আম্মুর সাথে সিরিয়াসলি কথা বলার সাহস পাইনি। তাঁর আজীবনের স্বপ্ন আমি মেডিকেলে পড়বো, একদম বাচ্চা বয়স থেকে ডাক্তার শুনে শুনেই বড় হয়েছি, ক্লাশ নাইনে বায়োলজি পড়তে গিয়ে, এবং নানারকম জটিল ড্রইং আঁকতে গিয়ে পর্যুদস্ত হয়ে বুঝতে পারি বায়োলজি লাইনে আমার চলবে না, ম্যাথটা ভালো লাগতো (যদিও এখন বুঝি নাম্বারের স্কিল বা মেন্টাল মাল্টিপ্লিকেশন পিওর আর্টস, এটা মানেই ম্যাথমেটিক্স না)। ইন্টারে তাকে না জানিয়েই বায়োলজি বাদ দিয়ে স্ট্যাটিসটিক্স নিই, এই অপরাধ সে এখনো ক্ষমা করতে পারেনি, তার ইমোশনটা আমি ধারণ করতে পারিনি আসলে। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া আমার আর অপশন ছিলো না, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনশিপ এ পড়ার ইচ্ছার কথা জানানোর তো প্রশ্নই ছিলো না।
যৌবনের অধিকাংশ সময়ই হতাশায় নিমজ্জিত। সাইন্স না বুঝার খেসারত বুয়েট লাইফে চড়া মূল্যে শোধ করতে হয়েছে। হতাশা কাটানোর একমাত্র মাধ্যম ছিল লেখালিখি আর ব্লগিং। ক্যারিয়ার বলতে কিছু আছে এই ব্যাপারটা মাথাতেই ছিলো না, ভাবতাম লেখালিখি করেই জীবন কেটে যাবে। তার ধারাবাহিকতায় এক সময় ৪টা বইও প্রকাশিত হলো, কিন্তু সর্বশেষ ১ বছরে এই কনক্লুশানে উপনীত হয়েছি মানুষের সাইকোলজি আমি বুঝতে পারি না, ফলে আমার লেখাগুলো বায়বীয় ধরনের, এগুলো লেখার জন্য বই প্রকাশ করা এক ধরনের বিলাসিতা। ৭০ বছর পরে আমার লেখার পাঠক তৈরি হবে সেই আকাশকুসুম কল্পনায় সময় ব্যয় করার চাইতে সেই সময়টুকু আরও গ্রেটার কোনো পারপাস এর পেছনে ব্যয় করা উচিত। সুতরাং বই লেখা প্রোজেক্ট অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত। সংখ্যার প্রতি ভালো লাগা থেকে পাইয়ের মান মুখস্থ করেছিলাম ২৩৩৮ ডিজিট পর্যন্ত, চর্চার অভাব ছিলো বলেই বোধহয় পাই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
ভার্সিটি লাইফের হতাশা কাটানোর আরেকটা মাধ্যম ছিলো ফিল্ম মেকিংয়ের চেষ্টা করা, দুটো টেলিফিল্ম নির্মাণও করেছিলাম, কিন্তু দ্রুতই বুঝতে পারে মেকিং কাজটা আমার জন্য নয়, এটার জন্য যে টেকনিকাল স্কিল লাগে তা আমার নেই, এবং তা শেখার জন্য পর্যাপ্ত তাড়নাও বোধ করছি না। ফলে ফিল্ম-মেকিংয়ের ইচ্ছা বিকশিত হওয়ার পূর্বেই বাক্সবন্দী। তবে ফিল্মের স্ক্রিপ্ট লেখার ইচ্ছা এখনো আছে, সেটা অবশ্যই আর্ট ফিল্ম নয়, আর্ট এবং কমার্সকে মার্জ করে একটা রেসিপি তৈরির। এই ইচ্ছা যে খুব তীব্র লেভেলের তাও না।

এইসব নানা কিছু চেষ্টা করা ও লেগে না থেকে সরে আসার দরুণ আমার তারুণ্যের পুরো সময়টাই স্কিল ডেভেলমেন্ট এর ব্যাপারে নিদারুণ উদাসীনতার মধ্য দিয়ে কেটে গেছে। এর মধ্যেও সৌভাগ্যবশত, টেলিফিল্মের স্পন্সর নেয়াসূত্রে মাহমুদুল হাসান সোহাগ ভাইয়ের সাথে পরিচয়, এবং আর্থিক যোগান নিশ্চিত করার একটা মাধ্যমের সাথে জড়িয়ে পড়া হয় সম্পূর্ণ অসচেতনভাবেই। পরিবারের বাইরে যদি কোনো মানুষের প্রতি আমার গভীর ইমোশন কাজ করে তিনি এই সোহাগ ভাই। তার প্রতিষ্ঠানে কাজ করাসূত্রেই ‘ইনডিপেনডেন্ট ক্যারিয়ারিস্ট’ টার্মটার সাথে পরিচিত হই। সময় বাড়ার সাথে সাথে এই টার্মটার সিগনিফিক্যান্স আরও ভালোভাবে বুঝেছি।

ইনডিপেনডেন্ট ক্যারিয়ারিস্ট এর বাইরে আমি তিনটা সোশ্যাল এন্টারপ্রাইজের চেষ্টা করেছি: ইয়ুথ ডেভেলপমেন্ট, ক্রিকেট টিম এবং খোশগল্প.কম। কিন্তু দেখেছি, আমার উদ্যোগগুলো কেবলমাত্র সামাজিক উদ্যোগ টাইপ হচ্ছে, সেটার ফাইনান্সিয়াল মডেল নেই কোনো, ইয়ুথ ডেভেলপমেন্টের যদিওবা মডেল আছে একটা, তার মানিটারি ভ্যালু খুবই লো। ফলে আমার উদ্যোগগুলো কোনোটাই এন্টারপ্রাইজ লেভেলে উঠতে পারেনি। একটা বিষয় বুঝেছি, পৃথিবীতে নন-প্রফিটেবল অর্গানাইজেশন বলতে কিছু নেই, কারণ নন-প্রফিটগুলো চলেই আদতে কোনো না কোনো প্রফিটেবল অর্গানাইজেশনের ডোনেশনে, যে টাকাটা তারা ডোনেট করে নিজেদের ব্রান্ড ভ্যালু আরেকটু উপরে তুলতে যা মূলত এক ধরনের মার্কেটিং ইনভেস্টমেন্ট। নন-প্রফিটের মধ্যেই আছে প্রফিটের প্রতিবিম্ব।

তারুণ্য বা যৌবনের একটা কমন ফেনোমেনা বাদ পড়েছে। প্রেম। আমি যদিও নিজের পছন্দে বিয়ে করেছি, তবু আমাদের মধ্যে মুগ্ধতার চাইতে পারস্পরিক দায়িত্ববোধটাই বেশি কাজ করেছে আমার ধারণা। বিয়ের পরে বরং আমাদের মধ্যে ইমোশনাল এটাচমেন্ট তৈরি হয়েছে, মুগ্ধতা, নির্ভরতা, আস্থাশীলতার জায়গাগুলো গড়ে উঠেছে। সেই অর্থে আমি কনভেনশনাল বিবাহ পরবর্তী প্রেমের ধাঁধায় আচ্ছন্ন, তারুণ্যে প্রেমের যে জড়তা, কিছুটা ভয়-কিছু সংকোচের অনুভূতি সেই পথে যাওয়া হয়নি। তবে মন যে কখনো চায়নি তা নয়, ভার্সিটি লাইফে একটা ওয়ান-সাইডেড মোহ ছিলো, সেটা অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপি হয়েই থাকুক। সমবয়সী মেয়েদের সাথে কথা বলতে আড়ষ্টতা কাজ করতো ছোটবেলায়, আমার সেই লাজুকতার শৈশব আজও বড় হয়নি।

আমি জীবনে যা কিছু চেষ্টা করেছি কোনোটা নিয়েই সিরিয়াস হইনি, সাময়িক আনন্দ নিয়েই মেতে থেকেছি। কিন্তু একটা বিষয়ের গভীরে যেতে কঠোর অধ্যবসায়ের প্রয়োজন, সময়ের মূল্য সম্পর্কে সজাগ থাকতে হয়। আমি স্কুলের পরীক্ষায় অধ্যবসায়, সময়ের মূল্য- রচনাগুলো লিখে খাতায় নম্বর পেয়েছি ঠিকই, কখনো এর রিয়েল তাৎপর্য বুঝার চেষ্টা করিনি। সমস্যাকে এড়িয়ে, দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছি, যার দরুণ একজন অবিকশিত ব্যক্তিত্বের মানুষ হিসেবেই গড়ে উঠেছি, সময়ের সাথে যার বয়স বেড়েছে প্রজ্ঞা বাড়েনি।

নিজের স্ট্রেন্থটা বুঝতে হবে। দেরিতে হলেও সেটা ধরতে পেরেছি। আমার স্ট্রেন্থ এর জায়গা থিংকিং, উইকনেস নার্ভাসনেস। জীবনের ইন্টারভ্যাল পর্যন্ত স্ট্রেন্থ এর জায়গায় জোর দেয়া হয়নি, ইন্টারভ্যাল এর পরে সেখানেই যাবতীয় এফোর্ট ইনভেস্ট করবো, উইকনেস কাটাতে জোর চেষ্টা চালাবো। আমি বুঝেছি, সব ব্যাপারেই কিছু কিছু দক্ষতা আছে এমন মানুষেরা কর্মী হিসেবে ভালো, লিডার হিসেবে ভালো, কিন্তু কোনো একটা পার্টিকুলার ফিল্ড এ এক্সিলেন্স নিয়ে আসতে হলে তাকে অবশ্যই স্পেশালিস্ট হতে হবে। অধ্যবসায়হীন একজন মানুষের পক্ষে সেটা আদৌ সম্ভব হবে কিনা এটাই দেখার বিষয়। অধ্যবসায়হীনতা যদি আমার প্রাইড হয়, তাহলে কখনোই পারবো না, আর যদি এটাকে বারডেন মনে করি তাহলে হয়তোবা পারবো।
আরও দশ বছর বাঁচবো কিনা জানি না, বিশেষত ভূমিকম্প নিয়ে মাঝেমধ্যেই আতঙ্ক কাজ করে। তবু যদি বেঁচেই থাকি, জোর চেষ্টা করবো থিংকিং কে সর্বোচ্চ ইউটিলাইজ করে নিজের স্বপ্ন পূরণে ব্রতী হতে। একজন মিডিওকার মানুষ আসলে কত দূরে পৌঁছুতে পারে সেটাই দেখার বিষয়। চল্লিশ বছর বয়সটা খুব ক্রিটিকাল, সেই দশকে পৌঁছানোর পূর্বে যে সময়টুকু পাই সেটা প্রোপারলি কাজে লাগানোই লক্ষ্য।
এতো বড় বড় কথা লিখে দিনশেষে সেই ৯টা-৬টা অফিস মেনে কাজ করা এটাই যদি জীবনযাপন হয়, সেই একঘেয়েমিতাকে মেনে নেয়ার জন্য আমি প্রস্তুত নই।

চলে যাচ্ছে সময়, বাড়ছে বয়স, ফোকাসড হতে হবে আমাকেও। মেঠো ইঁদুরের মতো লুকিয়ে বেঁচেছি এতোকাল, এই ধারায় এবার একটু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে দেখা যাক।