গায়ক আসিফকে ‘ইন্টারেস্টিং মানুষ’ আখ্যা দিয়ে ২০১৮ তে একটি আর্টিকেল লিখেছিলাম, সেখানে উল্লেখ করেছিলাম কখনো সুযোগ হলে তার একটা সাক্ষাৎকার নিব। সুস্পষ্টভাবে বলেছিলাম তার গান, গায়কি একেবারেই আমার মিউজিক টেস্টের সাথে মিলে না, তার টার্গেট অডিয়েন্স আলাদা, কিন্তু তার জীবন নিয়ে আমার আগ্রহ আছে। লেখাটি নজরে পড়ে তার ফেসবুক পেজ এডমিন ইলিয়াসের, আসিফ নিজেও কমেন্ট করেছিলেন সেখানে, তার মগবাজারের অফিসে দেখা হয় এক সন্ধ্যায়, ঘন্টা দেড়েক আলাপও করি।
কুমিল্লার ৬-৭ জন মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠতা আছে যাদের কেউ সরাসরি আসিফের কলেজ সহপাঠী কিংবা তার বাকি ৪ ভাইয়ের কারো না কারো বন্ধু। ফলে তার প্রথমজীবনের, এবং স্টারডম পাওয়া পরবর্তী অসংখ্য গল্পই শোনা হয়েছে। শোনা কথায় সবসময়ই শাখা-প্রশাখা গজায়, তবে মূল এসেন্স বা নির্যাস সম্বন্ধে আইডিয়া পাওয়া যায়। তাই সেসব কথাকে ঢালাওভাবে সত্যি ধরা যায় না, উড়িয়ে দেয়াটাও সমীচীন নয়।
সিনেমায় যেমন দেখা যায় এক তরুণ হৈ হুল্লোড় করে বেড়ায়, একবার এলাকায় সিনেমার শুটিং হচ্ছে, নায়ক একটা শট দিচ্ছে পরিচালকের মনমতো হচ্ছে না, শুটিং দেখতে আসা তরুণটি টিটকারি করছে নায়ককে, অপমানিত নায়ক তাকে চ্যালেঞ্জ জানালো ক্যামেরার সামনে এক্টিং করার, সে এমন এক্টিং করলো পরিচালক অভিভূত হয়ে তাকেই সিনেমায় নিয়ে নিল, সে হয়ে গেল সুপারস্টার। কিংবা অসংখ্য সিনেমায় আমরা দেখেছি গান গেয়ে জিরো থেকে হিরো হওয়ার সবচাইতে পরিচিত উপায় গান গাওয়া৷ আসিফও তো সেই গোত্রেরই একজন।
বিনোদন আর্টিস্টদের জীবন লটারির মতো। সবাই টিকিট কিনে পুরস্কার জিতে ২-১ জন। রিয়েলিটি শো এর সূত্রে নোলক বাবু, বিউটি, সালমা এর মতো সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের গায়করাও লটারি জিতেছিল, কিন্তু যথেষ্ট স্মার্ট না হওয়ায় লটারির সদ্ব্যবহার করতে পারেনি। আসিফ পেরেছে, সুতরাং তার ক্যালিবার আছে, সেটা আমার পছন্দ হোক না হোক, তা অনস্বীকার্য।
৪ বছর আগের সেই আলাপের পরে আসিফের সাথে আর দেখা বা কথা হয়নি আমার৷ তাই তার বায়োগ্রাফি প্রকাশিত হয়েছে এটাই জানা ছিল না।
জেনেছি নিতান্তই ঘটনাক্রমে।
এক অনুরাগী ক্ষুব্ধ হয়ে মেসেজ পাঠায়। তার ভাষ্য আসিফের মতো একজন স্টান্টবাজ এবং কথাসর্বস্ব ব্যক্তিকে আমি ইন্টারেস্টিং বলেছিলাম, সে আমার রুচিবোধ নিয়েই প্রশ্ন তুলে। ৪ বছর আগের লেখার রেফারেন্স টানার কারণ জিজ্ঞেস করে জানলাম তার প্রকাশিতব্য বায়োগ্রাফিতে তিনি সরাসরি লিখেছেন রকস্টার জেমস এলএসডি, প্যাথেডিন এ আসক্ত। একজন পাড় জেমস ভক্ত হিসেবে এটা সে কিছুতেই মানতে পারেনি। তার মতে আসিফ বুঝতে পেরেছে তার ওইসব মানহীন গান এখনকার জেনারেশন শুনবে না, তাই একে-ওকে নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে সে আলোচনায় থাকতে চাইছে৷ তাছাড়া তার ফ্যানদের বড় অংশই বই-পত্র পড়ে না, এসব বিতর্ক ইচ্ছাকৃত বিক্রি বাড়ানোর ধান্ধা। জেমসের উচিত মানহানি মামলা করা।
আমার বক্তব্য ছিল- একজন মানুষ ইন্টারেস্টিং মানেই সে নীচ প্রকৃতির হবে না এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তাছাড়া জেমসকে নিয়ে আমার যতই ফ্যাসিনেশন থাকুক সে যে চরম লেভেলের মাদকাসক্ত এটার জন্য তার মাদক গ্রহণের ভিডিও দেখার দরকার নেই আমার৷ সত্য শুনতে অপ্রিয় হলেও মানতে হবে। তাছাড়া আসিফ নিজেও তো মাদকসেবি সেই ছোটবেলা থেকে, এলাকায় তাকে লোকে চিনতো পুইট্টাখোর হিসেবে, শেয়ার ব্যবসায় তার কারণে বহু লোক ধরা খেয়েছে এমনও শুনেছি।
তাই কোন কনটেক্সট এ সে এসব লিখেছে বই না পড়ে মন্তব্য করাটা অনুচিত হচ্ছে। হতে পারে নিজের মাদকাসক্ত জীবনের জন্য অনুতাপ করতে গিয়ে অন্য অনেকের নাম জড়িয়েছে৷
সেই অনুরাগী যদি আমার প্রতি ক্ষুব্ধ না হতো আসিফের বায়োগ্রাফিটাও রয়ে যেত অপাঠ্যের তালিকাতেই।
বইটা লিখেছেন ৩য় একজন ব্যক্তি। বইয়ের কনটেন্টের দায় কি লেখকের, নাকি আসিফের। আমি নিজে যেহেতু বিভিন্ন অঙ্গনের প্রতিষ্ঠিত মানুষের বায়োগ্রাফি/চিন্তাগ্রাফি লিখে দিই, এখানকার অভিজ্ঞতা থেকে জানি এসব ক্ষেত্রে কনটেন্টে প্রচুর মডিফিকেশন আসে ব্যক্তির থেকে, শেষ পর্যন্ত বইতে সেসবই যায় যেগুলো সে দেখতে চায়।
তাই বায়োগ্রাফি লেখক রহিম নাকি রজত, ধর্তব্য নয়। এখানে লেখকের একমাত্র প্রশংসাযোগ্য অথবা সমালোচনাযোগ্য ফ্যাক্টর গদ্যশৈলি।
‘আমি সর্বাবস্থায় ভালো এবং সঠিক, অন্যরা মন্দ এবং ভুল’— এটা খুবই বিপজ্জনক প্রবণতা মানুষের। এরা কখনো নিজের ভুল স্বীকার করবে না, এবং যদি খুন-খারাবিও করে তার স্বপক্ষেও ব্যাখ্যা হাজির।
আসিফের ৩৭২ পৃষ্ঠার বায়োগ্রাফিতে এই প্রবণতাটাই প্রকটভাবে ভোকাল। প্রতিক্ষেত্রে তিনি ইনোসেন্ট।
এমন একটা পয়েন্ট পাওয়া গেল না যেখানে নিজেকে তার দোষী মনে হয়েছে। শওকত আলি ইমন তাকে ২ লাখ টাকা দিয়েছিলেন ডলার কিনতে, সেই টাকাটা ইমনেরই বন্ধু জোনাস তাকে ধোকা দিয়ে নিয়ে যায়, সেজন্য ইমন আসিফের উপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়, ইন্ডাস্ট্রিতে তাকে কাজ করতে না দেয়ার সবরকম চেষ্টা করে। এখানেও আসিফ নিজের ভুলটা স্বীকার করেছেন এমনভাবে পড়ে মনে হবে তিনি পরিস্থিতির শিকার, তার প্রতি আপনি সহমর্মি হয়ে উঠবেন।
বইয়ের প্রথম অংশজুড়ে বাবার ইমেজ ক্লিনিং, যেটা আরো স্মার্ট উপায়ে করা যেত হয়তবা। তার বাবা মুসলিম লীগের নেতা ছিলেন, দলীয় সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান জানিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে থাকতে পারেননি। সুতরাং রাজনৈতিক গ্রাউন্ডে তিনি স্বাধীনতা বিরোধী, এবং আমজনতার ভাষায় রাজাকার। ১৮ ই ডিসেম্বর তিনি গ্রেফতার হন। যুদ্ধাপরাধের যে সংজ্ঞা সেটা তিনি নাও করে থাকতে পারেন, কিন্তু স্বাধীনতা বিরোধী তথা রাজাকার এটা তো প্রমাণিত ফ্যাক্ট।
অথচ বইয়ের সূত্রে আমরা জানতে পারি তার বাবা মুসলিম লীগ করার সুবিধা নিয়ে বহু লোককে আর্মির ক্যাম্প থেকে বাঁচিয়েছেন, তরুণদের উদ্বুদ্ধ করেছেন আগরতলা থেকে ট্রেনিং নিতে। আন্ডারকভার এজেন্টের মতো তার বাবা একজন আন্ডারকভার মুক্তিযোদ্ধা। এতে তার বাবাকে যে আরো হাস্যোস্পদ বানানো হলো তা কি চিন্তা করেছেন? তার বাবা মক্কেলদের নিজের পয়সা দিয়ে সাহায্য করছেন, পয়সা তো নিচ্ছেনই না, মক্কেলদের যেভাবে বাড়িতে আপ্যায়ন করছেন— হুমায়ূন আহমেদের নাটকের বাবারা সাধারণত এরকম বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়ে থাকে।
আসিফের বায়োগ্রাফি প্রশ্নিবদ্ধ হয়েছে উৎসর্গ অংশেই।
সেখানে দাবি করা হয়েছে আসিফই নাকি বাংলাদেশে প্রথম ফ্যানডম তৈরি করেছেন আসিফিয়ান নামের কমিউনিটির মাধ্যমে। পডার পর মনে হলো বেচারা হুমায়ূন আহমেদ, আজম খান, জেমস, আইয়ুব বাচ্চু, নায়ক রাজ্জাক-সালমান শাহ-মান্না এরা কি তবে আসিফের আগে ফ্যানডম তৈরি না করেই এত জনপ্রিয়তা পেল!
বইতে কমপক্ষে ৬-৭ বার নিজেকে তিনি পরিচয় দিয়েছেন ‘বাংলাদেশের টপ সেলিব্রিটি’ ফ্রেজিংয়ের মাধ্যমে। এক জায়গায় নিজের গানের বা এলবামের চাহিদা বুঝিয়েছেন এভাবে ১ থেকে ১৯ পর্যন্ত আসিফ, ২০ নম্বর থেকে অন্য শিল্পী শুরু হয়!
মনে করার চেষ্টা করি ২০০১ এ তার ও প্রিয়া তুমি কোথায় এলবামটা যখন রিলিজ হয় সেসময় গানগুলো কোথায় শুনেছি। ক্যাসেটের দোকানে, সেলুনে, বাসে, চায়ের দোকানে। নটরডেমে যখন ভর্তি হলাম আমাদের এক সেকশনেই ছাত্র ছিল ১৬৯ জন, এরকম সেকশন ছিল আরো ৭ টা। ২ বছরে কোনোদিন কোনো ছেলের মিউজিক আলোচনায় আসিফ নামটি পজিটিভলি শুনিনি, উপরন্তু ‘ক্ষ্যাত’ এর উদাহরণ দিতে গেলে মনির খান, পলাশ, এসডি রুবেলের পাশে আসিফ নামটিও এসেছে কখনো সখনো৷ বুয়েটে নানা উপলক্ষেই ফেস্টিভাল আর কনসার্ট হত, থাকতাম হলে, কোন ফেস্টিভালে আসিফের গান কভার করেছে জানিনি, বুয়েটের কনসার্টে আসিফকে ডেকেছে তাও শুনিনি সিনিয়রদের মুখে; ঢাকা ভার্সিটি-ঢাকা মেডিকেলে আসিফের কনসার্ট কয়টা হয়েছে সেটাও খোঁজ নেয়া দরকার।
যে বাবলে আমি থেকেছি সেটা কন্ট্রোলড, সিলেক্টিভ এবং প্রিভিলেজড৷ এটা অবশ্যই সমগ্র বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করে না, এবং আসিফের ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ আসলেই অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে একটি ইউনিক ঘটনা। বেঁদের মেয়ে জোছনা ও তো বাংলাদেশের ফিল্ম ইতিহাসের সবচাইতে ব্যবসাসফল প্রজেক্ট, তার জোরে অঞ্জু ঘোষ যদি দাবি করে বসে সে-ই বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ নায়িকা! একই সিনেমা কলকাতায় রিমেক হয়েছে, সেখানেও নায়িকা অঞ্জু ঘোষই। সুতরাং আসিফের ১ থেকে ১৯ নম্বর পর্যন্ত পজিশন দাবি করার চাইতে অঞ্জু ঘোষ বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা নায়িকা স্বীকৃতি পাওয়া অনেক বেশি রিয়েলিস্টিক।
তিনি বিএনপির সমর্থক, খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের ভূয়সী প্রশংসার পেছনে রাজনৈতিক আনুগত্যের ব্যাপারটি অনুমানযোগ্য, তাতে বিশেষ সমস্যা দেখি না। কিন্তু নিজেকে বিএনপির জন্য যতটা মূল্যবান দাবি করেছেন বিএনপির হাই কমান্ড তাকে আদতেই অতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করে কিনা প্রশ্নটা রয়েই যায়। কারণ এমন কিছু রেফারেন্স তিনি উল্লেখ করেছেন যেগুলো কাজী হায়াতের বাংলা সিনেমা মানের কাহিনী৷ কয়েকটা উল্লেখ করি-
*কুমিল্লার কোন এক আসনে নির্বাচনের জন্য তিনি মনোনয়ন কিনেছেন। দলের হাই কমান্ড বিস্মিত। আসিফ শিল্পী মানুষ, গান নিয়ে থাকবে, সে কেন নির্বাচন করবে৷ খালেদা জিয়া তার ইন্টারভিউ নিচ্ছেন। আসিফ যা বলেন তার সারমর্ম হলো- ‘ম্যাডাম আমি চাই ওই আসনে আপনি নির্বাচন করুন, কুমিল্লায় লিডারের পোস্টিং ছিল, আপনি ওই এলাকার বউ। কিন্তু এই কথাগুলো বলার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ দরকার ছিল যেখানে দলের টপ লেভেলের সবাই থাকবে। শুধুমাত্র এজন্যই আমি মনোনয়ন পত্র কিনেছি’।
* কুমিল্লার এক জনসভায় তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় ‘কুমিল্লার কৃতি সন্তান, সঙ্গীতশিল্পী’ ফ্রেজিংয়ে। তার দলীয় পজিশন কেন উল্লেখ করা হলো না সেই ক্ষোভ থেকে সে ঘুষি মেরে বসে৷ এ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি হয়। চ্যানেল আই তে নিউজ আসে- কুমিল্লার জনসভায় আসিফ নিগৃহীত।
* গায়ক মনির খান প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করতে চেয়েও পারছিলেন না। আসিফ বড় মুখ করে নিয়ে যান। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পিএস শিমুল বিশ্বাস তাদের আধাঘন্টা বসিয়ে রাখেন৷ আসিফের ইগোতে লাগে৷ বেরিয়ে আসেন।
* কোন এক জনসভায় মঞ্চ নির্মাণের দায়িত্বে ছিল মির্জা ফখরুলের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। আসিফ দেখলেন মঞ্চ ছোট হয়েছে, এ নিয়ে তর্কাতর্কি হয়৷ খালেদা জিয়া নিজে তাকে ডেকোরেশনের সব দায়িত্ব দেন। পরে মির্জা ফখরুল তাকে ফোন করে বলেন- ‘দুই ভাই একসাথে কাজ করব’
* হাওয়া ভবনে তারেক রহমানের অফিসের যে বর্ননা দিয়েছেন পড়ার পরে ছোটবেলায় বইতে পড়া বিভিন্ন খলিফার জীবনযাপন মনে পড়ে- ‘বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়েও তিনি বাস করতেন কুড়েঘরে, টুপি সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন’৷ তারেক রহমান ওই অংশটুকু পড়লে ইমোশনাল হয়ে আসিফের বায়োগ্রাফি নিয়ে ফিল্ম নির্মাণেরও চিন্তা করতে পারেন কোনোদিন ক্ষমতায় এলে৷
* দলীয় প্রার্থীকে নির্বাচনে জেতাতে নিজের পকেট থেকে প্রচুর অর্থ খরচ করেছেন। কোনোদিন সেসব দাবি করেননি।
* অনেকে মনে করে তার এমপি-মন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন। তিনি নিঃস্বার্থভাবে দলকে ভালোবাসেন বলেই এতসব করেন, কে বুঝাবে তাদের!
যে কোনো বুদ্ধিমান মানুষ রেফারেন্সগুলো পর্যালোচনা করলেই একজন ক্লিকবাজ, মাতব্বর, এবং নিজে রাজার কাছে ভালো হয়ে অন্যদের খারাপ বানানোর প্রবণতা সম্পন্ন নীচু মানসিকতার মানুষ হিসেবে ডায়াগনোজ করবে তাকে৷
এবং এখানে এসেই বায়োগ্রাফি লেখার মোটিভটা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট থাকে না, যুক্ত হয় লেয়ার।
আসিফের বয়ানে আমরা জানি তার বন্ধু-বান্ধব সবাই মাদকাসক্ত৷ তিনি মাদককে ঘৃণা করেন। সেই বন্ধুদের যদি জিজ্ঞেস করা হয় আপনারা যখন ফেন্সিডিল বা অন্যান্য মাদক নিতেন তখন আসিফের এক্টিভিটি কী থাকত?
নির্মাণ স্কুল ক্রিকেট আর স্থানীয় লীগে টুকটাক খেলে নিজেকে যত বড় ক্রিকেটার হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেছেন সেও এক হাস্যকর বিষয় বটে। একটা ছেলে উনিশ বয়সে বিয়ে করেছে, তখন থেকেই নানাভাবে অর্থ উপার্জনের ধান্ধায় নামতে হয়েছে; সেই ছেলে ক্রিকেটে কী এমন প্যাশন বা ডেডিকেশন দেখাতে পারে। বরং ক্রিকেটের বল কেনার অর্থ যোগানোর ব্যাপারটাকে গ্লোরিফাই করতে গিয়ে সে যেসব পন্থার উল্লেখ করেছে সেখানে চুরির প্রসঙ্গটা এসেছে৷ এমনকি তার তৎকালীন প্রেমিকাকে বাসা থেকে উঠিয়ে আনার প্ল্যান করার সময়ের আলাপ থেকে ইঙ্গিত মিলে তিনি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসার সাথেও জড়িত ছিলেন।
নিজের দুটো দুর্বলতাকেই তিনি বইজুড়ে হাইলাইট করেছেন।
প্রথমত, মেজাজ হারিয়ে মারামারি করা। এই উপস্থাপনে কোনো অপরাধবোধ নেই, বরং মনে হবে মেজাজ হারিয়ে তিনি গর্বিত।
দ্বিতীয়ত মদ খাওয়া। মাদক মামলায় গ্রেফতার না হলে এই দুর্বলতাটা সামনে আসতো কিনা প্রশ্ন রয়েই যায়। বরং মদের ব্যাপারেও ব্যাখ্যা তৈরি। ২য় পুত্র রুদ্র এর জন্মের পর থেকে নাকি হার্ড লিকার বাদ, এখন এলকোহল বলতে শুধু বিয়ার, তাও ডাক্তারের পরামর্শে পরিমিত মাত্রায়। অথচ আমি যখন ২০১৮ তে তার সাথে দেড় ঘন্টা আলাপ করেছিলাম এক পর্যায়ে তিনি বলেন স্যরি বস রাত ৮টা বেজে গেলে খাইতে হয়, দীর্ঘদিনের অভ্যাস। দেড় ঘন্টায় ৩টা বিয়ারের ক্যান খালি করেছিলেন। ২০০৭ এ তার বয়স ৩৪, ওই বয়সে তিনি নাকি প্রথম গাঁজা সেবন শুরু করেন। এক্ষেত্রেও ডাক্তারের অনুমোদন হাজির করেন। ডাক্তার বলেছে গাঁজা খেলে আপনার ঘাড়ের ব্যথাটা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। মদ-গাঁজা-কোকেইন কোনোকিছু নিয়েই একজন অ্যারোগেন্ট মানুষের সমস্যা থাকার কারণ নেই, কিন্তু কেউ যখন প্রতিমুহূর্তে নিজের আচরণকে ডকুমেন্ট দিয়ে হালাল করার চেষ্টা করে তখন নিশ্চিত হওয়া যায় ব্যক্তিটি প্রকৃত অর্থে অ্যারোগেন্ট নয়, ভনিতা মাত্র। কলকাতায় শিলাজিত নামে এক গায়ক আছে, ন্যাচারাল অ্যারোগেন্ট। আবার নচিকেতা-অঞ্জন দত্ত এর কথা শুনলেও অ্যারোগেন্ট লাগে, কিন্তু দুয়ের ধরনে তুলনামূলক পর্যালোচনা করলেই ধরে ফেলা যায় নচিকেতা-অঞ্জনের কথাগুলো পাবলিসিটি স্ট্যান্টের বেশি কিছু নয়। আসিফের অ্যারোগেন্সও এই ঘরানার।
অনলাইন পোর্টালে জেমস আর পান্থ কানাইকে মাদকাসক্ত আখ্যা দিয়ে যে হট্টগোল খুবই সম্ভাবনা আছে এটা আসিফ নিজেই করিয়েছেন সাংবাদিকদের দিয়ে। কারণ বইতে তার ভাষ্যানুযায়ী সাংবাদিকদের তিনি সবসময় বশে রেখেছেন। যে কারণে অভিনেত্রী দীপা খন্দকারের সাথে এত গভীর প্রেম থাকা সত্ত্বেও কোনোদিন কোনো মিডিয়ায় এ সংক্রান্ত একটি সংবাদও আসেনি। মূল বইতে কিন্তু জেমস বা পান্থ কানাইয়ের নাম সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি। শীর্ষস্থানীয় রকস্টার, অন্যজনকে ড্রামার এভাবে লেখা হয়েছে। হতে পারে মিডিয়ায় প্রতিক্রিয়া তৈরির পরে তড়িঘড়ি এডিট করা হয়েছে।
অথচ এর চাইতেও গুরুতর অভিযোগ আইয়ুব বাচ্চুর বিরুদ্ধে। বাচ্চু-বিশ্বজিত-বেবি নাজনীনকে তিনি বলেছেন থ্রি-বি, যারা বাইরে শো করতে গেলে নিজস্ব সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে যেতেন, অন্য শিল্পীর গানের সময় তারা বিশ্রি সাউন্ড প্রোডিউস করত। রুপম নামের শিল্পীকে বলেছেন আইয়ুব বাচ্চুর ‘ঘেটু’, সেই রুপমকে বাচ্চুর ছায়া থেকে বের হতে বলেছেন বিধায় বাচ্চু তাকে ফোনে হুমকি দিয়ে বলেছেন তোর ঢাকায় আসা বন্ধ। এসআই টুটুল এলআরবি ছেড়ে নিজস্ব ক্যারিয়ার গড়ার উদ্যোগ নিলে বাচ্চু সবরকম চেষ্টা করেন যাতে কোনো প্রতিষ্ঠান তার অ্যালবাম না করে, আসিফ টুটুলকে প্রমোট করেছেন বিধায় বাচ্চুর সাথে তার প্রকাশ্য শত্রুতা তৈরি হয়। হতে পারে প্রতিটি কথাই সত্য, কিন্তু যেহেতু বাচ্চু আর বেঁচে নেই, আসিফের বক্তব্যের ব্যাপারে তার প্রতিক্রিয়া জানার সুযোগ থাকছে না, কিন্তু বাচ্চুর ফ্যানরা তো এতে ক্ষুব্ধ না হওয়ার কারণ দেখি না। আবার বাচ্চুর মৃত্যু তাকে কতটা আহত করেছে, জীবন-বিনোদন সংক্রান্ত দার্শনিকতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে সেসবও স্থান পেয়েছে। বইতে জেমস স্বনামে এসেছেন ২বার। প্রথমত, আসিফের অ্যালবাম নিয়ে জেমস নেগেটিভ মন্তব্য করেছেন, আসিফ পাল্টা জবাব দেয়ায় তৎকালীন সাংবাদিক সঞ্জীব চৌধুরি জেমসের পক্ষ নিয়ে তাকে বলেন- আপনি জানেন জেমস কে? তিনি প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন- আপনাকে আমি গোনায় ধরি না, আপনি যা পারেন করেন। আপনি আগে খোঁজ নিয়ে দেখেন আমি কে। সঞ্জীব চৌধুরী নাকি জানতে পারেন আসিফই ইন্ডাস্ট্রি কাঁপাচ্ছে এখন। দ্বিতীয়ত, বেবী নাজনীনের ভাই সাংবাদিক এনামকে পিটিয়েছিলেন, এজন্য নাকি জেমস ফোন করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
সুযোগ বুঝে বেশ কয়েকজনের প্রতি ঝালও মিটিয়েছেন। যেমন,
-গায়ক আগুন অপমান করার জন্য তাকে দিয়ে দোকান থেকে সিগারেট আনিয়েছিল। আগুনের মার্কেট ডাউন হয়ে যাচ্ছিল, নায়কের বদলে তার গানগুলো যাচ্ছিল ভিলেনের লিপে। আসিফ তার মার্কেট নষ্ট করছে, এজন্য তার প্রতি রাগ ছিল।
– গায়ক নাসির মাতাল অবস্থায় দুইজন ভাড়াটে খুনী নিয়ে গভীর রাতে তার অফিসে হাজির হয়। নাসির এসেছিল ইথুন বাবুর প্ররোচনায়। কারণ ইথুন বাবুর স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েছিল, এবং ইথুন বাবু স্ত্রীর কল লিস্ট চেক করে দেখেন আসিফের সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলার রেকর্ড। আসিফ অবশ্য দাবি করেছেন তিনি তখন এত বেশি রেকর্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, ফোন থাকতো আজম বাবুর কাছে, সেই তার ফোন থেকে কল করত ইথুন বাবুর স্ত্রীকে। আজম বাবুকে কয়েকটা চড়-থাপ্পর দেয়ার পরই নাকি সে দোষ স্বীকার করে নেয়। নাসিরের সাথে তার শত্রুতা কী নিয়ে তা অবশ্য বলা হয়নি।
-গায়ক পিয়াল হাসানের নাকি স্বভাব ভালো না। সে নাকি সবসময় নিজেকে বিটিভির মহাপরিচালকের পুত্র পরিচয় দিত। যখন যে-ই মহাপরিচালক হয় সে ই নাকি তার বাবা।
-আসিফ দীর্ঘদিন সিনেমায় শুধু নকল গান গেয়েছেন। পলাশ-রিজিয়া পারভীন নকল গান গেয়েই রমরমা বাজার তৈরি করেছে, ইথুন বাবু ও প্রিয়া তুমি কোথায় অ্যালবামের জন্য নাকি প্রথম পলাশকেই প্রস্তাব দিয়েছিলাম। পলাশ নাকি নকল গানে এত ব্যস্ত ছিল যে মৌলিক-ফৌলিক গাওয়ার সময় নেই বলে মানা করে দিয়েছে।
-এন্ড্রু কিশোর বিশেষ প্রয়োজনে প্রায়ই নেপাল যেতেন। তার ঘনিষ্ঠজনেরা জানতো সে ব্যাপারে। কথাটা ইঙ্গিতপূর্ণ।
-আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তাকে বাদ দিয়েছিলেন, কারণ হারমোনিয়াম-গিটার কোনো ধরনের ইনস্ট্রুমেন্টই তিনি বাজাতে জানেন না, কিছুই না শেখা শুধু গলাসর্বস্ব গায়ককে দিয়ে তিনি গান করাবেন না। পরে কাজী হায়াতের ইতিহাস সিনেমায় গান গাওয়ার জন্য পরিচালক নিজে ফোন করলেও আসিফ ঘুরাতে থাকেন। বুলবুল নিজে ফোন করে অনুরোধ করার পরে তিনি গান গাইতে সম্মতি দেন।
আসিফ বইজুড়ে অসংখ্যবার বলেছেন ব্যবসা তাকে দিয়ে হবে না, নিজের টাকা গুনে রাখতে পারেন না। অথচ সাউন্ড সিস্টেম ভাড়ার ব্যবসা করেই তার সংসার চলেছে দীর্ঘদিন। মূলত সাউন্ড সিস্টেম ভাড়ার ব্যবসা করতে গিয়েই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর শো তে ওয়ার্ম আপ সিঙ্গার হিসেবে গান করার সুযোগ পেতেন। নিজে আর্ব মিউজিক নামে প্রতিষ্ঠান দিয়েছিলেন, সেখানে অনেকের বিনিয়োগও ছিল। শেয়ার ব্যবসা তো করেন সেই কুমিল্লায় থাকাকালীনই। তার মেঝ ভাই, যিনি আর্মি অফিসার, ৪০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন, সেটা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে ১৩ লক্ষ টাকা পর্যন্ত উন্নীত করেছিলেন।
অফিসে কালা জাহাঙ্গীর, সর্বহারা গ্রুপের আনাগোনা প্রভৃতি রেফারেন্সগুলোর মাধ্যমে ধারণা পাওয়া যায় আন্ডারওয়ার্ড বা সর্বহারা গ্রুপেও তার বিচরণ থাকতে পারে। তিনি কেরানিগঞ্জে এক পীরের মুরিদও হয়েছিলেন।
আসিফ গান থেকে রিটায়ারমেন্টের আগে যে বর্ণনা দিয়েছেন এটাও ২০১৮ তে বসে ২০১০ এর প্লট বানানো মনে হয়েছে। বরং ব্যাপারটা এভাবে দেখা যায়, বিএনপির শাসনামলে তিনি যতটা দাপট দেখিয়েছেন বিএনপি ক্ষমতা হারানোর পরে বেবী নাজনীন, প্রমিথিউসের বিপ্লব, অভিনেতা বাবুল আহমেদ, খুরশিদ উজ জামান উৎপল প্রমুখ যেমন দৃশ্যপটের বাইরে চলে গেছেন, তিনিও মূলত আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু যেহেতু ‘আমি ভুল করতে পারি না’ সিনড্রোম তার মধ্যে প্রকট, ক্যামোফ্লেজ একটা থাকবেই।
যখন জেনেছিলাম আসিফের স্ত্রী তার চাইতে বয়সে বড় তখন থেকেই তার মনোজগত আমাকে অন্যভাবে ভাবাতো। আমার বইয়ের সকল নারী ক্যারেক্টার বয়সে আমার চাইতে বড়ো হয়, সমবয়সী বা বয়সে ছোট মেয়েদের সবসময়ই এড়িয়ে চলেছি। বয়সে বড়ো কোনো নারীর মনে রোমান্টিকতা তৈরি করা বিরাট চ্যালেঞ্জিং কাজ মনে হয়। আসিফ সেই যুগে পেরেছিলেন, আমি এই যুগেও পারিনি কখনো, এই বোধটি বরাবরই আসিফের ব্যাপারে ভিন্নভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করত। তবে বইতে আসিফ তার স্ত্রীকে যেভাবে উপস্থাপন করলেন তাতে এটুকু বলা যায় জীবনভর তার প্রতি প্রচণ্ড অত্যাচার করেছেন। কয়েকটা রেফারেন্স দিই-
*বিয়ের পূর্বেই মিতু গর্ভবতী হয়ে পড়েন। সঙ্গত কারণেই অ্যাবোরশন করতে হয়। বিয়ের পরে পুনরায় গর্ভবতী হলে শাশুড়ির ইচ্ছায় ২য় বার অ্যাবোরশন করাতে হয়, কারণ আসিফের বয়স তখনো কম, উপার্জনক্ষম হয়নি। ৩য় বারও আবোরশনেরও জন্য চাপ ছিল, কিন্তু সেবার আর তিনি রাজি হননি।
* ২ ভাইয়ের একমাত্র বোন, অথচ গত ৩০স বছর ধরে পরিবারের সাথে সবরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।
* রামপুরার বাসায় শিশুপুত্রকে নিয়ে যখন নিতান্ত দারিদ্রের মধ্যে দিনাতিপাত করছে তখনো বাসায় ৮-১০ জন অতিথি লেগেই থাকত। তিনি এ নিয়ে কোনোরূপ উচ্চবাচ্য করেননি।
*আসিফ বাসায় এসে আধাঘন্টা ডাকাডাকি করেও দরজা না খোলায় দরজা ভেঙ্গে দেখা যায় তিনি ছেলেসহ ঘুমিয়ে আছেন। এই অপরাধে তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়, পুত্রসহ পরদিন দুপুর পর্যন্ত তিনি বাসার সিড়িতে বসে কাটিয়ে দেন।
*আসিফ রাত ২টায় বাসায় এসেছে দীপা খন্দকারকে নিয়ে। দীপা তার কাছে আসিফকে বিয়ে করার লিখিত অনুমতি চায়। তিনি বলেন তোমরা প্রেম করার সময় তো আমার অনুমতি নাওনি, এখন অনুমতির দরকার কী; চাইলে বিয়ে করতে পারো আমার আপত্তি নেই, আমি কোথাও লিখিত দিতে পারবো না। আসিফের দাবি দীপাকে তিনি এনেছিলেন যাতে মিতু তাকে বুঝিয়ে শান্ত করে, উল্টো আসিফকে তিনি দীপার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে আসিফ তাকে এমন চড় মারেন যে নাক ফেটে যায়।
* কুমিল্লায় যাচ্ছেন, মাঝপথে পুত্রসহ আসিফ তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছে বকাঝকা করে। তার অপরাধ আসিফের সাথে কথা না বলেই পারিবারিক সিদ্ধান্ত দিয়েছে। পরবর্তীতে ঢাকায় ফিরে আসিফ বাসা ছেড়ে চলে যায়, অফিসকেই বাসা বানিয়ে থাকে ১৪ দিন। মিতু নাকি তার কোনো খোঁজই নেয়নি।
*আসিফের ভাষায় মিতু বেয়াদব। সে যখন যেখানে ইচ্ছা চলে যায়। তাকে না জানিয়ে কলকাতায় চলে গেছে বাংলাদেশের টেস্ট ম্যাচ দেখতে। আসিফের কন্যা সন্তানের শখ ছিল, কিন্তু মিতু আর গর্ভধারণে আগ্রহী নয়। তার ইচ্ছা ছিল পুত্রদের নিজের কাছে রাখবার, মিতু কোনো আলোচনা না করেই পুত্রদের পাঠিয়ে দিয়েছে খুলনায় পড়াশোনা করতে।
*নিজের চাইতে ২০ বছরের ছোট এক মেয়েকে বিবাহ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে আসিফ। রওনক নামের সেই মেয়েটি ছিল আসিফের অন্ধভক্ত। প্রথম যখন দেখে মেয়েটি মাত্র ক্লাস ফোরে পড়ে। সময়ের পরিক্রমায় মেয়েটি সিটি কলেজে অনার্সে ভর্তি হয়। আসিফ তাকে ফোন-ল্যাপটপ কিনে দেন। মিতু ছেলেসহ তার হোস্টেলে গিয়ে দেখেন হোস্টেলের পরিবেশ ভালো না। আসিফ তাকে মোহাম্মদপুরে বাসা ভাড়া করে দেন, নিজের অফিসে চাকরিও দেন। যে মেয়েটি তাকে মামা ডাকতো, মিতুকে মামী সে-ই হয়ে উঠে আসিফের হৃদয়ের রানী।
আসিফের বায়োগ্রাফি থেকে দুটো ইন্টারেস্টিং ফ্যাক্ট পেয়েছি, এ দুটোর জন্য হলেও বইটাকে হেল্পফুল বলবো
*খালিদ হাসান মিলুর ঠিক কী হয়েছিল এটা নিয়ে দীর্ঘদিনের কৌতূহল ছিল। মিলুর গান ভালো লাগতো। হঠাৎ একদিন ইত্যাদির প্রতিবেদনে তার দূরাবস্থা দেখি। নিজেও ছোট ছিলাম তখন। বইসূত্রে জানলাম মিলুরা এক বাসায় আড্ডা দিচ্ছিল রেকর্ডিং শেষে, প্রত্যেকেই ছিল ড্রাংক। নিজেদের মধ্যে নেশার ঘোরে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে কে যেন ভারি চামচ দিয়ে আঘাত করেছিল মিলুর মাথায়। তখন টের না পেলেও সেখান থেকেই ব্রেইন হ্যামারেজ হয়।
*মনি কিশোরকে নিয়ে ছোটবেলায় খুব ঠাট্টা-মশকরা করতাম। বিশেষত তার কী ছিলে আমার গানটা শুনলেই ভাবতাম ব্যর্থ প্রেমিক মদ খেতে খেতে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। আসিফরা দুষ্টুমি করে মনি কিশোর ফ্যান ক্লাব খুলেছিলেন। মনি কিশোরের কিছু আলাপ বেশ ইনসাইটফুল।
আসিফের গান যেহেতু আমার একেবারেই পছন্দ নয়, তার প্রতি আমার সেই ইমোশনাল অ্যাটাচমেন্ট তৈরি হওয়ার কারণ নেই। কিন্তু ইলিয়াস যেহেতু তার পেজ অ্যাডমিন তার অনুভূতি নিশ্চয়ই অন্য লেভেলের। ৪ বছর পূর্বে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আসিফের প্রতি এত অনুভূতির কারণ কী। সঙ্গে এও জিজ্ঞেস করেছিলাম আসিফ যে দাবি করে সে ২০০০ গানে কণ্ঠ দিয়েছে এটা কি সত্যি। সে জানায় ১৫০০ এর বেশি গানের লিস্ট তার নিজের কাছেই আছে, সুতরাং দাবি মিথ্যা হওয়ার সুযোগ নেই। আসিফের বন্ধুবাৎসল্য এর বেশ কিছু গল্প শোনালো। তাছাড়া একদম অচেনা একজন হওয়া সত্ত্বেও আসিফ তাকে যেভাবে পারিবারিক সদস্যের মতো ট্রিট করে সেটাও বিরাট ব্যাপার। ইনফ্যাক্ট সেই ইলিয়াসের কথা স্থান পেয়েছে বায়োগ্রাফিতেও।
আসিফ একজন আমুদে প্রকৃতির মানুষও বটে। তার স্বৈরচারিতায় আনুগত্য স্বীকার করে নিলে তিনি আপনাকে সবরকম ঝামেলা থেকে বাঁচানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন।
আসিফ জেলে থাকার যে বর্ণনা দিয়েছেন এই বইয়ের সবচাইতে ফিলোসফিকাল অংশ আসলে এটিই।
বইয়ের নাম নট আউট ফিফটি, অর্থাৎ শত প্রতিকূলতার মধ্যেও আকবর নামের ব্যক্তিটি নট আউট হননি, পৌঁছে গেছেন ৫০ এ। ব্যাপারটা ক্রিকেটিয়। আমি নিজেও যেহেতু ক্রিকেট অনুরাগী, আমার বিবেচনায় আকবর আদতে ৫০নয়, ১৮ তেই আটকে আছেন ইম্যাচিউর চিন্তা বা আচরণে, এবং নিজের অবস্থান জাহির করতে গিয়ে আউট হয়ে গেছেন। তবে বোল্ড-ক্যাচ বা এলবি নয়, অন্যদের প্রতি তার যে দৃষ্টিভঙ্গি সেই আলোকে আউটের নাম ‘অবস্ট্রাকটিং দ্য ফিল্ড’!