আমরা গড়পড়তা মানুষেরা এক জীবনে কতজন ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি? সংখ্যাটা যদি অনেক বড় হয় তবুও সেটা ১৪-১৫ এর বেশি হওয়ার সম্ভাবনা কম, গড় হয়তোবা ৭-৮ জন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ওই ৭-৮ জন ডাক্তারই আমার/আমাদের পারসেপশন তৈরি করে দিচ্ছে একটি বিশাল ও ব্যাপক পেশাজীবীর ব্যাপারে। ওই ৭-৮ জন ডাক্তারের বেশিরভাগ যদি ভালো আচরণ করে, তাহলে ডাক্তার মানে ভালো, আর যদি খারাপ আচরণ করে তখন ডাক্তার হয়ে যাবে কসাই, চামার, কিংবা কমিশনখোর। যে কোনো গণপেশাজীবীর সাথে ইন্টারেকশনের ক্ষেত্রে এটা একটা অবশ্যম্ভাবী চ্যালেঞ্জ; তার ব্যক্তিগত আচরণ বা কার্যক্রম সমগ্র পেশাটিকে সার্টিফাই করে।
অবশ্য আমাদের জীবনের প্রায় সকল পারসেপশনই পারশিয়াল ডাটার প্রেক্ষিতে তৈরি হয়, এবং ব্যক্তিগত জীবনের বা নিজস্ব গণ্ডির অভিজ্ঞতা কিছুটা অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। যেমন, প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে, এর সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষকের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে; ফলে কমন পারসেপশন বা স্টেটমেন্ট হয়ে যাবে- প্রশ্নফাঁসের সাথে শিক্ষকরাই জড়িত। কিংবা একটা স্কুলের ৫ জন শিক্ষক প্রাইভেট টিউশনি করান, এদের মধ্যে ২ জন ছাত্রদের প্রাইভেট পড়তে চাপাচাপি করেন, না পড়লে পরীক্ষায় কম নম্বর দেন; স্টেটমেন্টটা দাঁড়িয়ে যাবে শিক্ষকরা প্রাইভেট পড়ানোর জন্য মুখিয়ে থাকে, এবং ভালো নম্বর পাওয়ার একমাত্র শর্ত স্যারের কাছে পড়তে যেতে হবে।
ডাক্তারের ব্যাপারে লিখতে গিয়ে শিক্ষক পেশাকে রেফারেন্স হিসেবে দেয়ার কারণ এটাই। যে পেশাগুলো আমাদের গণজীবনের সাথে গভীরভাবে জড়িত, সেগুলো নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার পরিমাণও বেশি, এবং দুঃখের বিষয় হলো, ভালো কাজগুলো সেভাবে উঠে আসে কম, খারাপগুলোই সয়লাব হয়ে যায়। ফলে যাদের ভালো করার ইচ্ছা ছিলো বা আছে, তাদের মধ্য থেকেও স্পৃহা উবে যাবে। এটা একটা দুষ্টচক্রের মতো কাজ করে। মেডিকেলে ভর্তির সময় যার নাম ছিলো শরীফ, এমবিবিএস পাশ করার পর তার পরিচয় হয় ‘ডাক্তার’, শরীফ নামটি বলতে গেলে বিলুপ্তপ্রায়। এই শরীফের মাসে ১০ দিন নাইট ডিউটি করার কথা, তার মধ্যে ১দিন ডিউটি না করে বাসায় থাকলো এবং সেদিনই রাতে ৩ জন ইমার্জেন্সি প্যাশেন্ট এলো , হতে পারে তার একজন আমি নিজে বা আমার ঘনিষ্ঠ কেউ, ফলে আমার তখন দেখার সুযোগ নেই শরীফ মাত্র ১ দিন ডিউটি মিস করলো কিনা, বরং তার কারণে আমি সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি, এটাই সত্যি এবং চিরস্থায়ী ইমপ্রেশন হয়ে যাবে। জীবনের চাইতে বড় কিছু তো নেই। আমরা যা কিছু করি সব তো ওই জীবনকে যাপনের উদ্দেশ্যেই।
ডাক্তারের সাথে সরাসরি জীবন-মরণের ইস্যুগুলো জড়িত থাকে বলে আমাদের রেশনাল মাইন্ড ইচ্ছা সত্ত্বেও যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে পারে না, ইমোশন তখন রেশনালিটির উপর বিজয়ী হয়। এই কারণে সেই শরীফের অনুপস্থিতিকে আমি/আমরা জীবনভর এভাবে দেখবো- অমানুষ ডাক্তারের কারণে আমি আমার আপনজনকে হারিয়েছি। ডাক্তারের শরীরে মানুষের রক্ত নেই। অথচ আমরা প্রত্যেকে অন্তত ১৫-২০ বার ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়ে সেবা পেয়েছি, সেটা খুব বড় ব্যাপার হবে না, কারণ আমরা ধরেই নিয়েছি, ডাক্তারের সেবা পাওয়া আমাদের মৌলিক অধিকার; ‘যার যেটা কাজ সেটুকুই করার জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার তো কিছু নেই’- এই অদ্ভুত আত্মকেন্দ্রিক চিন্তার প্যাটার্ন থেকে একজন ডাক্তার স্বয়ংও হয়তোবা মুক্ত নয়; তার আপন কেউ ডাক্তারের অভাবে মারা গেলে সে সেইমুহূর্তকালে আত্মপরিচয় বিস্মৃত হয়ে নিজেকে একজন ভিক্টিম এর জায়গায় বসিয়ে ফেলবে। আবারো বলি, জীবনের চাইতে বড় কিছু নয়।
ধরা যাক, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে প্রতিমাসে ১৫০০০ বার বাস-ট্রাক চলাচল করে; এর মধ্যে ১০ বার দর্ঘটনা ঘটলো। পরিসংখ্যান বলবে, ১৫০০০ এর সাপেক্ষে ১০ খুবই নগণ্য সংখ্যা, কিন্তু সেই ১০টা দুর্ঘটনাই ওই মহাসড়ককে মৃতুফাঁদ হিসেবে পরিচিত করতে যথেষ্ট, এবং আপনি/আমি যখন যাতায়াত করবো, মনের মধ্যে ভয় কাজ করবে, ওই ১০টার ১টা আমার গাড়িটিই নয় তো? ডাক্তারের ব্যাপারটাও তেমন। এতো বেশিমাত্রার স্পর্শকাতর ইস্যু নিয়ে ডিল করতে হয় যে, সামান্যতম বিচ্যুতিই ভয়ানক সর্বনাশ ডেকে আনে। এরকম ১০০% পারফেকশনিস্ট মডেল আর কোনো পেশায় আছে কিনা খতিয়ে দেখা দরকার। যেহেতু ১০০% কখনো সম্ভব নয়, ৯০% পারফেকশনও বিশাল বিচ্যুতি, কারণ ৯০% এর চাইতে ১০%ই বড় হয়ে উঠবে। ডাক্তারিই বোধহয় একমাত্র সেক্টর যেখানে গাণিতিক পরিসংখ্যান পুরোপুরিই অর্থহীন, এখানকার প্রতিটি সিঙ্গেল ঘটনা একেকটি বিরাট কেস স্টাডি। যেমন, কোনো হাসপাতালে মাসে ১০০টি অপারেশন হয়, এর মধ্যে ২টি অপারেশনের সময় ভুলবশত রোগীর পেটের ভেতর ব্যান্ডেজের কাপড় রয়ে গিয়েছিলো। সেই ২টি অপারেশন মানে ২টি আলাদা ফ্যামিলি, এবং সেইসূত্রে আরও অনেক মানুষ। সেই ২ জনের ১ জন রংপুর, অন্যজন বাগেরহাটের বাসিন্দা। ফলে, বাগেরহাট আর রংপুরের প্রায় অঞ্চলজুড়ে মানুষ জানবে, অমুক হাসপাতালের ডাক্তাররা খুবই ইনসিনসিয়ার, ওখানে অপারেশনের পর ব্যান্ডেজ থাকে পেটের ভেতর। আর যদি কোনোভাবে, এই সংবাদটি পেপারে আসে, তাহলে তো রাষ্ট্র হয়ে যাবে।
একটা গল্প পড়েছিলাম, রাজার উপকার করায় এক ব্যক্তিকে রাজা জিজ্ঞেস করলেন তার ইচ্ছা কী; সে বললো একদিনের জন্য রাজা হতে চায়; রাজা মঞ্জুর করলেন সেই ইচ্ছা। পরদিন রাজা তার কাছে জানতে চাইলেন, অনুভূতি কী। সে হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেন, ‘সবই তো ভালো, কিন্তু মাথার ওপর তলোয়ার ঝুলে থাকে, এই ভয়েই তো অন্যকিছুতে মন বসাতে পারলাম না, কখন ওই তলোয়ার মাথার উপর এসে পড়ে’। রাজা তখন বললেন- এইবার বুঝেছো রাজা হওয়ার যন্ত্রণা? এই গল্পের সাথে ডাক্তারদের জীবনচিত্র খুবই প্রাসঙ্গিক।
সাম্প্রতিক কালের এডমিন বা ফরেন ক্যাডার ক্রেজ বাদ দিলে, এখনো পর্যন্ত ভালো ছাত্র-ছাত্রী মানেই ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার। ক্লাশ ফোর থেকে ক্লাশ নাইন পর্যন্ত রেন্ডমলি ১০০ জন স্টুডেন্ট সিলেক্ট করে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বড় হয়ে কী হতে চাও, কমপক্ষে ৯০ জন বলবে ডাক্তার অথবা ইঞ্জিনিয়ার। বিশেষত, ঢাকার বাইরে এই পারসেন্টেজটা আরও বেশি। আমরা ত্রিশোর্ধ্ব শিক্ষিত মানুষেরা প্রায় প্রত্যেকেই জীবনের একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার ছিলাম। ফলে আমাদের মনন, স্বপনে বসবাস করে ডাক্তার; নিজে হতে না পারলেও সন্তানদের কেউ না কেউ ডাক্তার হোক। যে ৯০ জন কিশোর-কিশোরী বলছে ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়, তাদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কেন ডাক্তার; ব্যাংকার বা আইনজীবী নয় কেন? বেশিরভাগই গঠনমূলক উত্তর দিতে পারবে না, আব্বু-আম্মু চায়, তাই। ওই বয়সের মানুষের কাছ থেকে খুব বেশি অর্গানাইজড চিন্তা আশা করাটাও একটু বাড়াবাড়ি, তবু আব্বু-আম্মু চায় বলেই ডাক্তার হওয়া, এটার মধ্যে একটা বড় সমস্যা লুকিয়ে আছে।
এক্ষেত্রে একটু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করা প্রয়োজন। আমার আম্মুর জীবনের সবচাইতে বড় কষ্ট, আমি তাকে না জানিয়েই ইন্টারে বায়োলজি বাদ দিয়েছিলাম, যে কারণে ডাক্তার হওয়ার প্রশ্নই আসেনি। আজ ১২ বছর পরও আম্মু প্রসঙ্গ উঠলেই সেই কষ্টের কথা স্মরণ করিয়ে ইমোশনাল হয়ে পড়ে। যে কারণে ২০০৭ থেকে আমি একটা কাজ করছি। ছেলে-মেয়ে ডাক্তারি পড়ছে বা পড়াতে চায়, এরকম অভিভাবকের দেখা পেলেই তাদের সাথে আলাপের চেষ্টা করি, একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে। গত ১০ বছরে প্রায় ৭০-৮০ জন অভিভাবকের সাথে আলাপ করতে পেরেছি।আমার প্রশ্নটা খুব সিম্পল- ‘কেন ডাক্তার’? উত্তরগুলোকে সামারাইজ করলে ৩টা মেজর পয়েন্ট পাওয়া যায়- ১. ডাক্তার কখনো বেকার থাকে না। বিসিএস এ যদি নাও টিকে, প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেও প্রচুর টাকা উপার্জন করতে পারবে। ২. ছেলে-মেয়ে ডাক্তার হলে পরিচিত মানুষজন আর সমাজের কাছে কদর বেড়ে যায়, সবাই সমীহ করে চলে। আত্মীয়-স্বজনের ছেলে-মেয়েদের সাথে তুলনা করা যায়। ৩. ফ্যামিলিতে একজন ডাক্তার থাকা ভালো। কখন বিপদ-আপদ আসে বলা তো যায় না। ডাক্তার থাকলে সেই টেনশন নেই। আমার অসুখে সন্তান যদি কাজেই না এলো, তাহলে সেই সন্তানের কী দরকার!
এবার আগের প্যারার সমস্যাটা খোলাসা করা যাক। ৩টি মেজর পয়েন্টের প্রতিটিই অর্থনৈতিক আর সামাজিক স্ট্যাটাস/সিকিউরিটি ওরিয়েন্টেড। যেহেতু ডাক্তার হওয়ার ক্ষেত্রে ভিশন বা প্যাশন নেই, গভীর কোনো ভালোবাসা নেই, স্রেফ মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করাটাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রধান উদ্দেশ্য, সেক্ষেত্রে মুদি দোকানদার কিংবা মাছের আড়তদারের সাথে পেশাগত মিশনে ডাক্তারি আলাদা কিছু হতে পারে না অনেকসময়ই। বিশেষ করে, এমবিবিএস এর পর আরও উচ্চতর ডিগ্রি (স্পেশালি ফরেন ডিগ্রি) নেয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় কারণ হয়, ভিজিটের পরিমাণ বাড়ানো। অন্য পেশাজীবীর ক্যারিয়ার যেখানে ২৬-২৭ বছর বয়সে শুরু হয়, উচ্চতর ডিগ্রি নেয়া ডাক্তার প্র্যাকটিসে বসতে হয়তোবা ৩৮-৩৯ বয়সে পৌঁছে যায়। তর্কের খাতিরে বলা যেতে পারে, মেডিকেল সাইন্স বিষয়ে আরও ব্যাপকভাবে জানার উদ্দেশ্যেই এতো ডিগ্রি, তবু কমন সাইকোলজিতে ডাক্তারের নামের শেষে ১০-১৫টা ডিগ্রি বিশাল ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে, এই সত্য অস্বীকার করার জো নেই। এবং এর একটি আলামত হিসেবে প্রায় প্রতিবছর মেডিকেল পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের ঘটনাকে দেখা যেতে পারে। যে লোক ১০ লাখ টাকা খরচ করে প্রশ্ন কিনেছে, ২০ লাখ টাকা তুলে না আনা পর্যন্ত তার স্বস্তি কোথায়! এ কথার মানে এই নয় যে, মেডিকেলে ভর্তি হওয়া সবাই প্রশ্ন কিনে বা দুর্নীতি করে চান্স পায়। কিন্তু ১০%ও যদি এভাবে চান্স পায়, এবং ডাক্তার হয়ে বের হয়ে প্র্যাকটিস করে, তার কাছ থেকে রোগী কতটুকু মানসম্পন্ন সার্ভিস পাবে? একজন ডাক্তারের কাছে গিয়ে তো জিজ্ঞেস করা সম্ভব নয়, ডাক্তার সাহেব আপনি মেধা দিয়ে পাশ করেছেন, নাকি প্রশ্ন কিনে ডাক্তার হয়েছেন! প্রসঙ্গটা শেষতক জীবন ইস্যুতেই গিয়ে ঠেকে। আবারো বলি, জীবনের চাইতে বড় কিছু নয়।
ডাক্তারদের বিরুদ্ধে অভিযোগের চাইতেও বেশি অভিযোগ হাসপাতাল নিয়ে। বেড নেই, নার্স, ডাক্তার নেই, রোগী ফ্লোরে শুয়ে কাতরাচ্ছে, ডাক্তারের খবর নেই। কিংবা বেসরকারী হাসপাতালে গেলে, প্রচুর বিল ধরিয়ে দেয়। আমাদের লাইফস্টাইল এবং খাদ্যাভ্যাস এতোটাই অনিয়ন্ত্রিত যে, আমাদের অসুস্থ হওয়ার হার অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় অনেক বেশি। যে হাসপাতালে ২০০ টি বেড আছে, সেখানে যদি ১৫০০ রোগী আসে, তখন সিট বাণিজ্য চলবে এটাই তো স্বাভাবিক, কারণ যে কোনো সিস্টেমেই কিছু নষ্ট মানুষ থাকে সিস্টেমকে কুক্ষিগত করে রাখতে। প্রাইভেট হাসপাতালগুলো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো, যা দরিদ্র বা স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। প্রাইভেট হাসপাতালের বিল বিষয়ে সরকারি কোনো নীতিমালা আছে কিনা জানি না, তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় নেই। যে কারণে, চিকিৎসা সেবার প্রায় বড় অংশটাই সরকারি হাসপাতাল দিয়ে পূরণ করতে হয়, এবং সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা অধিকাংশ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মতোই। যেহেতু ক্যাপাসিটির তুলনায় চাহিদা অনেক অনেক বেশি, সেই অপ্রতুলতা পূরণ করা বাস্তবিকই অসম্ভব। অথচ সমস্ত দায় গিয়ে পড়ে ওই ডাক্তারের ওপর।
ডাক্তারের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, খারাপ ব্যবহার। ধরা যাক, আমার বা আপনার আপন কেউ মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, ডাক্তার তাকে খুব ভালোমতো ট্রিটমেন্ট দিলো না। আপনি এই একটা ঘটনা নিয়েই পেরেশানে আছেন; ডাক্তারের কাছে কতরকম জটিল সমস্যা নিয়ে সারাদিন আসে হাসপাতালে- হার্ট এটাক, বিষ খাওয়া, স্ট্রোক, খিঁচুনি, এক্সিডেন্ট, আরও কত কি। এতোসব জটিল সমস্যা দেখতে দেখতে ডাক্তারের আসলে গা-সওয়া হয়ে যায়। তারা প্রতিনিয়ত জন্ম-মৃত্যু দেখে। আপনার হাতে একজন মানুষ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে, এই স্মৃতি সারাজীবনে ভুলতে পারবেন না; অথচ ডাক্তার প্রায় প্রতিদিন কতগুলো মৃত্যু দেখে। একজন বিবস্ত্র মহিলা বা উলঙ্গ পুরুষ দেখলে সাধারণ মানুষের শরীর শিরশির করে উঠে সাধারণত, কিন্তু ডাক্তারকে সেসবও মোকাবিলা করতে হয়। তার কাছে এটা একটা দেহের চাইতে বেশি কিছু নয়। যতই শরীর সম্পর্কে জানুক, চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধে জানুক; তবু মানুষ তো। তাই ডাক্তারদের নির্বিকারত্ব বা কোনোকিছুকেই সিরিয়াসলি না দেখার ক্ষেত্রে এটা একটা ভাইটাল ফ্যাক্টর হয়ে থাকতে পারে।
আরেকটি অভিযোগ ডায়াগনোস্টিক সেন্টার আর ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানীগুলোর কাছ থেকে কমিশন নেওয়া। ডাক্তারের কাছে গেলেই একগাদা টেস্ট ধরিয়ে দেবে, বা সুনির্দিষ্ট কোম্পানীর ওষুধের নাম প্রেসক্রিপশনে লিখবে- এরকম একটা কমন পারসেপশন অনেকদিন ধরেই প্রচলিত আমাদের জনসমাজে। ধরা যাক, আপনি একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা; আপনার হাত দিয়ে কোটি টাকার টেন্ডার পাশ হয়। ৫ জন টেন্ডার জমা দিলো, যে আপনাকে কমিশন দিবে আপনি টেন্ডারটা তাকেই দেবেন। সেই আপনিই যখন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছেন, তার কাছ থেকে নৈতিকতা আশা করছেন, এবং না পেয়ে তাকে চিহ্নিত করছেন দুর্নীতিবাজ হিসেবে।‘ তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইবো না কেন’?- থিমটা তো এরকমই হওয়া উচিত। অন্যরা দুর্নীতি করছে বলে ডাক্তারের দুর্নীতির সাফাই গাইতে হবে, এমনও নয় কিন্তু ব্যাপারটা। কিন্তু ডাক্তার আসলে কে বা কারা? আমাদের এই সমাজের আলো-বাতাস নিয়েই তো তারা বেড়ে উঠে, বেঁচে থাকে।
সততার ইনডেক্স এ আমরা এতোটাই নিচের দিকে অবস্থান করি যে, একটি সুনির্দিষ্ট পেশাজীবী আলাদা করে ইনডেক্সের ওপরের দিকে থাকবে, এটা পুরোপুরি ন্যাচারের নিয়মকে ভায়োলেট করে। একটা সহজ উদাহরণ দিই; আপনি প্রতিদন রিকশায় একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যে যান ৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে, কোনো একদিন এক রিকশাওয়লা অজ্ঞতাবশত ২০ টাকা ভাড়া চাইলো; আপনি কি বাড়তি ১০ টাকা দেবেন কখনো? কিংবা, দোকানে কিনতে গেছেন; ৩৬০ টাকার বিপরীতে ৫০০ টাকার নোট দিয়েছেন, দোকানী ভুলবশত ২৪০ টাকা ফেরত দিলো। আপনি কি তাকে ১০০ টাকা বেশি দেয়ার ঘটনাটা মনে করিয়ে দেবেন? আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে এরকম অজস্র ঘটনা ঘটে যেখানে আমরা পরিস্থিতির সুযোগ নিই। ডাক্তাররাও এর মধ্যে জড়িয়ে পড়ে, কারণ আমাদের মোরাল স্ট্যান্ডার্ড একদম তলানীতে গিয়ে ঠেকে। পহেলা বৈশাখের আগে ইলিশের দাম হুট করে আকাশচুম্বী হয়ে যায় কেন? কিংবা আরবে পাঠানোর কথা বলে ৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া, কিংবা অফিসের পিয়ন পদে নিয়োগের জন্য ১০ লাখ টাকার কনট্রাক্ট- এসব ঘটনা কারা ঘটাচ্ছে? আশপাশে তাকান, খুব পরিচিত মানুষ; দূরগ্রহের এলিয়েন কেউ নয়। যে যেভাবে পারছে সুযোগ নিচ্ছে, এই যদি পরিস্থিতি হয়, তখন ইট আর হীরা একই দরে বিক্রি হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক বাস্তবতা।
জেলাশহরগুলোতে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিজনেস সবচাইতে রমরমা। পিলপিল করে মানুষ আসে। সেখানকার সেবার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য আদৌ কি কোনো রুলস আছে? হয়তোবা কাগজে-কলমে আছে, তার বাস্তবায়ন কোথায়? ফার্মাসিটিক্যাল কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টেটিভরা বলতে গেলে সারাদিনই ডাক্তারের রুমে বসে থাকে, ডাক্তারকে গিফট দেয়, কারণ এটাই তাদের চাকরি। একজন জজ যদি সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রে রেস্ট্রিকশন পেতে পারে, একজন ডাক্তারের সাথে কীভাবে রিপ্রেজেন্টেটিভের ওঠা-বসা হয়; এক্ষেত্রে রেস্ট্রিকশন কোথায়? সমগ্র ফার্মাসিটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি টিকে থাকা না থাকার ব্যাপারটি এর সঙ্গে জড়িত। বিলিয়ন ডলারের ব্যাপার-স্যাপার; একজন সাধারণ ডাক্তারের কী-ই বা করার থাকতে পারে এক্ষেত্রে? আমরা নিজেরা ঝামেলা দেখলেই যেখানে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি, ডাক্তারও তো তা-ই করে। তার মানে অবশ্য সব ডাক্তারই কম্প্রোমাইজ করে তা নয়, কিন্তু টিকে থাকতে হলে যে পরিমাণ শক্ত মেরুদণ্ড থাকা দরকার, সেটা বেশিরভাগ মানুষের থাকে না।
ডাক্তার কেন হতে চাই, এরকম রচনা লিখতে দিলে গড়গড় করে লিখে দেয়া যায়, মানবসেবাই পরমধর্ম; সৃষ্টিকর্তার পর ডাক্তারের উপর মানুষের নির্ভরশীলতা বেশি, এরকম হাজার হাজার লাইন। আবারো লক্ষ্য করা যাক,একটা ব্যাপারে। বাংলাদেশে ডাক্তার হয় কারা? সাধারণত ছোটবেলা থেকেই যারা পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড হয় সেইসব মানুষ। অধিকাংশ ফার্স্ট বয়ের বৈশিষ্ট্য কী? পড়াশোনার বাইরে অন্যকিছুতে আগ্রহ কম, যে কোনোভাবে ফার্স্ট হতে চাওয়াই একমাত্র লক্ষ্য, বন্ধুবান্ধব খুবই কম।ব্যতিক্রমও আছে, তবে যে কোনো ম্যাসিভ সেক্টর বিবেচনার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমকে বাদ রেখেই হিসাব করা হয়। ছোটবেলা থেকেই প্রবল আত্মকেন্দ্রিকতা ধারণ করে যারা বড় হয়েছেন, একদিন হুট করে তার মধ্যে মানবসেবা ঢুকবে, এটা একটু বাড়াবাড়ি প্রত্যাশা। ডাক্তারদের কারিকুলামে সোস্যাল ওয়ার্ক বা দুস্থদের সাথে ১-২ বছর টানা সময় কাটানো, প্রভৃতি ব্যাপারগুলো আছে কিনা জানি না, তবে থাকলে হয়তোবা প্র্যাকটিসে যাওয়ার সময় ওই ২ বছরের অভিজ্ঞতাগুলো তাদের আরও বেশি মানবিক করে তুলতো।
ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারের মতো টেকনিকাল এবং এপ্লাইড সেক্টরগুলোতে বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ বেশি, পিওর সাইন্সের কদর নেই বললেই চলে। আমাদের এখানে সোশ্যাল সাইন্স, ইকোনমিক্স বা ফিজিক্স পড়তে চাওয়া মানুষের সংখ্যা অগণিত, কারণ এগুলো পড়তে ভালো লাগে, বোঝার আছে। কিন্তু এসব সাবজেক্টে পড়তে দেয়া হয় না, কারণ চাকরি নেই, গবেষণার ফান্ডিং নেই। যারা তারপরও প্রচণ্ড ইচ্ছা নিয়ে ভর্তি হয়, বেশিরভাগই শেষমেষ বিরক্তির চাকরিতে সেটেলড হয় পারিবারিক-সামাজিক প্রেসারে, আর কিছুসংখ্যক মানুষ চেষ্টা-তদবির করে উচ্চশিক্ষার্থে দেশের বাইরে চলে যায়। ফিজিক্স বা ইকোনমিক্স তাহলে পড়বে কেন? ফিজিক্স পড়ে যদি ক্যাশ সেকশনে চাকরি করতে হয়, এতো প্যাশনের ফিজিক্স বা ইকোনমিক্স তাহলে কী ফায়দা দেবে? যে কারণে আমাদের মৌলিক গবেষণায় প্রসিদ্ধি খুবই কম, এপ্লাইড সেক্টরই টিকে থাকার ভরসা, সোস্যাল স্ট্যাটাস বৃদ্ধিকারক।
ডাক্তারদের নিয়ে যতই অভিযোগ করেন, একবার ভাবুন, দেশের সব ডাক্তার একযোগে মাত্র ১ দিনের জন্য কর্মবিরতিতে গেলো; কী হবে ভেবেছেন? যে কোনো পেশাজীবীর ক্ষেত্রেই এটা সত্য। মাত্র কিছুদিন আগে পরিবহন ধর্মঘটের কারণে দেশ অচল হয়ে গিয়েছিলো। আমরা যেমন এইসব পেশাজীবীর বাঁচার উৎস, অনুরূপভাবে এদের কারণেই আমরা সারভাইভ করি। সমাজের ভিত্তিই এরূপ পারস্পরিক সহযোগিতা এবং স্কিল এক্সচেঞ্জ। কিন্তু আত্মসর্বস্বতা আমাদের এতোটাই সংকীর্ণ করে ফেলে যে, নিজের ভুবনের বাইরে যে কোনোকিছুকে খারাপ দৃষ্টিতে দেখা, অভিযুক্ত করতে পারলে ভালো লাগে। বাংলা ভাষায় একটা শব্দ আছে ‘পরশ্রীকাতরতা’। একে ইংরেজি করলে কী হয় Envy বা Jealous? আমি মনে করি, এর কোনোটাই পরশ্রীকাতরতাকে ধারণ করতে পারে না। আমাদের জাতিগত অভ্যাস যে পরশ্রীকাতরতা, সেখানে দোষারোপ সংস্কৃতি, অমঙ্গল কামনা তো ঘটবেই।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার মান ও পরিবেশ নিয়ে সন্তুষ্ট নই। কিন্তু সাথে সাথে এটাও বিশ্বাস করি, এজন্য একতরফাভাবে ডাক্তারের দোষারোপ করাও একপ্রকার সুগারকোটেড ন্যাচার। আপনার সন্তানকে যখন ডাক্তার বানাবেন বলে স্বপ্ন দেখছেন, তাকে প্রতিদিন অন্তত ১ বার হলেও বলুন, পৃথিবীতে টাকাওয়ালা মানুষের অভাব নেই, কিন্তু মানুষের মতো মানুষ খুব খুব কম। যা ইচ্ছা তা-ই হইয়ো, কিন্তু দিনশেষে মানুষ হতে ভুলো না। জীবনের চাইতে বড় কিছু নেই। দেখবেন ২০ বছর পর, ডাক্তারদের নিয়ে অভিযোগ ৭৫% কমে গেছে। একটা বিশাল প্রজন্ম তৈরির ভার আপনার উপর ন্যস্ত; অভিযোগ ভুলে সেই ভার বহনের জন্য নিজের কাঁধটুকু চওড়া করুন।
জীবন খোঁজে জীবন, হারানোর ভয় কী আছে?