দল হিসেবে বাংলাদেশ এখন কোন্ পর্যায়ে আছে, আমাদের কি পরাশক্তি হিসেবে গণ্য করা যায়? এটি একটি অবান্তর প্রশ্ন, কারণ পরাশক্তি এক-দুইদিনের কোনো ট্রেন্ড নয়, এর সঙ্গে অনেকগুলো ফ্যাক্টর জড়িত, যেগুলো পূরণ করবার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রস্তুতি নেই এখনো।
তবে ২০০৭ বিশ্বকাপের পর থেকেই বিশ্বক্রিকেট একটি নতুন আবর্তে প্রবেশ করেছে, অস্ট্রেলিয়ার একাধিপত্যের অবসানের পর বিগত দশ বছরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর জিম্বাবুইয়ে বাদে ক্রিকেটিয় দলগুলোর মধ্যে একটি সাদৃশ্য পাওয়া যায়, সেটা হলো ভালনারেবিলিটি, অর্থাৎ যে কোনো সময় কলাপস করে, এবং হোম এডভান্টেজের ফায়দা নিবে। ফলে এখনকার ক্রিকেটে পরাশক্তি বলতে কিছু নেই; ভিরাট কোহলির বদৌলতে ভারত সামান্য এগিয়ে আছে. ইংল্যান্ড কিছুটা ব্যালান্স করে চলছে, এই যা। অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা বা নিউজিল্যান্ড দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবশত এখনো পারফরম করে যাচ্ছে, কিন্তু গ্রোথ বা পারফরমিং গ্রাফটা চিন্তা করলে সেটা আগের চাইতে নিম্নগামী। পাকিস্তান, শ্রীলংকাও খুব স্ট্যাবিলিটির মধ্যে নেই। সামগ্রীকভাবেই ভালনারেবিলিটি এই সময়ের ক্রিকেটে জেঁকে বসেছে; হোক সেটা টেস্ট বা ওয়ানডে। টি২০ তো কমার্শিয়াল সিনেমার মতোই ফরমুলা ক্রিকেট, এটা বরং দেশ বনাম দেশ এর চাইতে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক হলেই বিনোদন বাড়ে বেশি।
ভালনারেবল হওয়ায় সুবিধা হলো, দলগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে, সুনির্দিষ্ট একটি-দুটি দলের সাথে ম্যাচের আগেই ফলাফল প্রেডিক্ট করা যায় না। তবে এখনকার ভালনারেবিলিটিটা স্পষ্ট স্কিলের অভাব থেকে সৃষ্ট,এজন্য পারফরমিং আর্ট হিসেবে খেলা দেখতে চাওয়া দর্শকদের মনে অস্বস্তি কাজ করা স্বাভাবিক। ভালনারেবল বৈশিষ্ট্যে চার-ছক্কা মারার স্কিল হয়তো বেড়েছে, কিন্তু ইনিংস বিল্ড আপ, পার্টনারশিপ, থ্রেট বোলিং প্রভৃতি মৌলিক আর্টগুলো বিলুপ্তপ্রায়। বাঙালি চোখে না দেখে অস্ট্রেলিয় বা ইংলিশ চোখে যদি ব্যাপারটা দেখি, যেখানে ক্রিকেট কেবলই একটি খেলা, তাহলে স্কিলকে আর্টের চাইতে সাইন্স বা টাইম পাসিং এন্টারটেইনমেন্ট হিসেবে মূল্যায়ন করে ভালনারেবিলিটিটা খুবই স্বাভাবিক ধরে নেয়া যায়। এই ভালনারেবিলিটির মধ্যে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে বাংলাদেশ নিয়মিত জিততে শুরু করেছিলো, এবং সেই কনফিডেন্সের ইনফ্লুয়েন্সে টেস্টেও জেতার অভ্যাস রপ্ত করতে শিখেছে সম্প্রতি। জয়ের অভিজ্ঞতাহীন একটি দেশের ক্রিকেট জয়ের সাথে নিয়মিত বিরতিতে পরিচিত হতে শুরু করলে ইনিশিয়াল টারমোয়েলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কথা, যেহেতু জাতিগত এবং ব্যক্তিগতভাবে আমাদের এক্সিলেন্ট অ্যাচিভমেন্টের জায়গাটা খুবই সীমিত। উদাহণস্বরূপ বললে, নব্য ধনিকশ্রেণির আচরণগত কিছু ত্রুটি থাকে, হঠাৎ পাওয়া স্ট্যাটাস-প্রতিপত্তির সাপেক্ষে নিজের অবস্থানগত উত্তরণকে একসূত্রে গাঁথতে না পেরে অসংলগ্ন আচরণ করে যার প্রেক্ষিতে আঙুল ফুলে কলাগাছ এর মতো বাগধারার সৃষ্টি হয়, এবং এর সাথে ভৌগলিক ইতিহাস জড়িত বলে সর্বত্রই সেই রেশ পড়ে। ভারত বা বাংলাদেশের ক্রিকেট সমর্থকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ এই সিনড্রোমের শিকার।
ফুটবলের সাপেক্ষে চিন্তা করলে ক্রিকেট বিশ্ব একটা মহল্লার চাইতে বড় কিছু নয়, এবং এমন একটা অজো মহল্লা যেখান থেকে মেইনরোডে যেতে দুবার রিক্সা বদল করতে হয়। ইংল্যান্ড বাদে বাকি দেশগুলোর কোনোটিই বিশ্বরাজনীতি বা অর্থনীতিতে বিগশট জাতীয় কিছু নয়। এরকম একটি অকিঞ্চিৎকর পরিমণ্ডল, হোক সেটা মাত্র ১০-১১টা নিরীহ আর মিডিওকর অর্থনীতির দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ (ভারত, অস্ট্রেলিয়া বিশ্বরাজনীতিতে সমীহ জাগালেও নিয়ন্তা পর্যায়ের কিছু নয় নিশ্চয়ই), সেখানে বাংলাদেশ জায়গা পেয়েছে, এতেই জান্নাত পাওয়ার সুসংবাদের মতো খুশি হয়ে যায় অধিকাংশ ক্রিকেট দর্শক। কারণ, সিনেমা, সাহিত্য, ব্যবসা, আইটিসহ কোনো সেক্টরেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমরা সর্বোচ্চ পজিশনে বিলং করি না, এমনকি ৩ জনের মধ্যেও আমরা ৩য় হই সবসময়। আমাদের নায়ক সাকিব খান, মোশাররফ করিম, টিভি চ্যানেল মোহনা টিভি; মেধাহীনতার এমন মহামারীতে ক্রিকেট অন্তত মেকি বৈশ্বিকতার কৃত্রিম আনন্দটুকু দেয়। এবং এটা আরও জোরালো হয় যখন টিভি চ্যানেল, সোস্যাল মিডিয়া আর পত্র্রপত্রিকাসূত্রে আমরা ক্রমাগত জানি, ক্রিকেট বিশ্বদরবারে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে, দেশের মুখকে উজ্জ্বল করছে (ওইসব লেখায় কোথাও অবশ্য উল্লেখ থাকে না ওই বিশ্বের আকার আসলে কতটুকু), এবং ক্রিকেট হয়ে উঠে ন্যাশনালিজমের সিম্বল। ফলে অর্থনীতি বা রাজনৈতিক কূটনীতিতে পিছিয়ে পড়ে খেলার মাঠে হারিয়ে দিলে সেটা হয়ে যায় গ্রেট লেভেলার, সীমান্ত হত্যার জবাব! এমনই অদ্ভুত অ্যানালজি! টিম গেমগুলো বরাবরই প্রচণ্ড পলিটিক্যাল, হোক সেটা ক্রিকেট, ফুটবল, রাগবি বা বাস্কেটবল, যে দেশ যেটাকে প্রোমোট করে। একারণেই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের আগে এতো উত্তেজনা, বা রাজনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হলেই একে অপরের সাথে ক্রিকেট খেলা বন্ধ রাখে।
আবেগ কখনো উগ্রতায় রূপ নেয়, কিন্তু এই আবেগ ফ্যাক্টরের কারণেই ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ হলেও স্টেডিয়ামের বাইরের মানুষও সেভাবে খবর রাখে না, অন্যদিকে ভারত বিশ্বকাপে প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় নিলে ক্রিকেটারদের বাড়িতে হামলা হয়, জিতলে মিছিল বের হয়, সবটাই বাড়াবাড়ি। এই বাড়াবাড়িতাই বিজনেস। বাড়াবাড়ি আছে বলেই ভারত- বাংলাদেশে জাতীয় দলের ক্রিকেটাররা দেশের অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তি; ওই প্রচণ্ড উগ্র কিংবা আবেগী মানুষগুলোই আগের রাতে লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেনে, তাও না পেলে ২০০ টাকার টিকিট ব্ল্যাকে কেনে ১২০০ টাকায়, তবু ম্যাচ দেখা চাই, অথচ ওই ১২০০ টাকাটাও সে হয়তো কারো কাছ থেকে ধার করে এনেছে। এইসকল আপাত ইমোশনাল ফুলকে ট্র্যাপ করেই টেলকোগুলো কোটি টাকার স্পন্সর দেয়, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে ফার্স্ট অপশন রাখে ক্রিকেটারকে। এটা একটা ইলিউশনের মতো।
একটা অদ্ভুত চিন্তা মাথায় ঘুরছে কয়েকদিন ধরে। ফেসবুকে বা অন্যান্য অনলাইন মিডিয়ায় ক্রিকেট নিয়ে যারা হেট স্পিস প্রমোট করে সেই মানুষগুলোর গড় বয়স কত, ব্যাকগ্রাউন্ড কী, কিংবা স্টেডিয়ামে ২৫ হাজার দর্শকের মধ্যে ৪০+ বয়সী মানুষ কত হাজার? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ঘাঁটাঘাটি করলাম, এবং লক্ষ্য করলাম, ট্রল করা বা হেট স্পিস দেয়া মানুষগুলোর ৮০% এরই বয়স ২৫ এর কম,( এর মধ্যে কলেজ পড়ুয়াদের সংখ্যা সবচাইতে বেশি), ১০-১২% এর মতো আছে ২৫-৩৫ এই বয়সসীমার, এবং বড়জোর ২% হবে যাদের বয়স এর চাইতে বেশি। তার মানে দেখা যাচ্ছে, ক্রিকেটভোক্তার পুরোটাই তরুণশ্রেণি যারা নিজেরা স্বাবলম্বী হয়নি এখনো সেভাবে। পরনির্ভরশীল মানুষেরাই কী-বোর্ডকে ছুরি বানিয়ে ক্রমাগত পিঠ থেকে পিঠে ছুরি চালিয়ে যাচ্ছে, বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। সাংবাদিক দেবব্রত মুখার্জীকে তার বইয়ে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে মাশরাফি সংশয় প্রকাশ করেছিলেন দেশে ৩ কোটি মানুষ ক্রিকেট ফলো করে কিনা, সেই ফ্যাক্ট বিষয়ে। আমার সংশয় সংখ্যাটা ২ কোটিরও কম হবে, তবু এটার ইমপ্যাক্ট এবং ইনটেনসিটি অনেক বেশি, কারণ ক্রিকেট ফলোয়ারদের বড় অংশই বয়সে তরুণ, তারাই সোস্যাল এবং প্রিন্ট মিডিয়ার ধারক, বাহক, সঞ্চারক; এই একটা পয়েন্টে এসেই ক্রিকেট অন্য সবকিছুকে টেক্কা দিয়ে উপরে উঠে গেছে, কারণ সাকিব খানের সিনেমা, হৃদয় খানের গান তাদের টানে না, ওয়েস্টার্ন মুভি আর মিউজিকের পাশে তারা নিতান্তই অ্যামেচার, ক্রিকেটে তো সেটা নেই; অস্ট্রেলিয়া বা ভারতের ক্রিকেটারদের চাইতে বাংলাদেশী মাশরাফি, সাকিব অনেক বেশি গ্ল্যামারাস আর আপন হয়ে উঠে।
ক্রিকেট সেন্সের সাথে পর্যবেক্ষণ, চিন্তাশীলতা, ইনসাইট এই ৩টি যোগ্যতা গভীরভাবে জড়িত। ক্রিকেট মানে তো ব্যাট বল আর স্ট্যাটিসটিক্স নয় কেবলমাত্র, যদিও ক্রিকেট সেন্স মাপতে এগুলোই সর্বাগ্রে কনসিডারেশনে নেয়া হয়। বৃহত্তম অংশের মানুষের মধ্যে উল্লিখিত সফট স্কিল ৩টির নিদারুণ ঘাটতি, সেন্স বা প্রজ্ঞা ডেভেলপ করবে কীভাবে? উপরন্তু পরচর্চা, ষঢ়যন্ত্র তত্ত্ব খোঁজা আমাদের জাতীয় অভ্যাস; এরকম প্রোফাইলের মানুষ নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের অযোগ্যতা, অদক্ষতাকে আড়াল করতে ক্রিকেটকে আঁকড়ে ধরতে চাইবে, এ আর ব্যতিক্রমী কী হলো! আগামী দুই বছর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইভেন্টে বাংলাদেশ হকি দল যদি হরহামেশাই চ্যাম্পিয়ন হয়, বা হঠাৎ করে বিশ্বকাপে খেলার যোগ্যতা অর্জন করে নেয়, রাতারাতি হকি হয়ে যাবে এখানকার জনপ্রিয়তম খেলা; জিমি, চয়নরা তখন দেশের সৈনিক। কিছুদিন আগে ফেসবুকেই একটা লেখা পড়েছিলাম, ১৯৯৭ এর আইসিসি ট্রফিতে যাওয়ার জন্য বিমান ভাড়া যোগাড় করতেই নাকি বিসিবিকে স্ট্রাগল করতে হয়েছে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান রাজি হয়েছিলো সহায়তা করতে, আর ২০ বছর পরে ২০১৭ তে এসে ৬ কোটি টাকা বোনাস পায় ক্রিকেটাররা। ক্রিকেটই বোধহয় একমাত্র সেক্টর যেখানে এমন অকল্পনীয় গ্রোথ সম্ভব হয়েছে, এবং যেটা দাঁড়িয়ে আছে পুরো হাওয়ার ওপর। আইসিসি বাংলাদেশের ওপর কোনো কারণে নিষেধাজ্ঞা দিলো, বা ২ বছর সব কয়টা সিরিজে হোয়াইটওয়াশ হোক, বেতন আদায় করতে আন্দোলনে নামতে হবে ক্রিকেটারদের। অবশ্য এন্টারটেইনমেন্ট সেক্টরটাই এমন; এককালে আজম খানের কনসার্ট দেখার জন্য মানুষের ঢল নামতো, এখন সেই জায়গাটা চলে গেছে অন্য কারো দখলে। ক্রিকেটকে এন্টারটেইনমেন্টের চাইতে ন্যাশনালিজমের সিম্বল হিসেবেই দেখে ক্রিকেটপ্রেমীরা; শাফিন আহমেদের গান বা আরিফিন শুভর সিনেমায় কেউ বাংলাদেশ পায় না, কিন্তু তামিম ইকবালের ব্যাটে ঠিকই জেগে থাকে বাংলাদেশ! স্পোর্টস কখন কীভাবে মানুষের কগনিটিভ বিহেভিয়ারে ঢুকে পড়ে এ সংক্রান্ত প্রচুর গবেষণা আর্টিকেল পাওয়া যায়, আগ্রহীরা পড়ে নিতে পারেন।
ক্রিকেট ম্যাচিউরিটি কি আদৌ প্রয়োজন? জীবনযাপনের সর্বক্ষেত্রে আমরা যেখানে ধর তক্তা মার পেরেক (বা ইমিডিয়েট গেইন) নীতিতে চলি, সেখানে ক্রিকেট ব্যতিক্রমী হবে কেন, এবং সেটা সম্ভবপর কিনা এই প্রশ্নই চলে আসে সর্বাগ্রে। শত বছরের অভ্যাস সহজে বদলাবে না, ম্যাচিউরিটিও আসবে না, তবু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ জাতীয় দল হয়তোবা মাঝেমধ্যেই জিতবে, এমনকি কোনো একটা বিশ্বকাপের ফাইনালেও খেলতে পারে, কিন্তু অভিজাত শ্রেণিতে উঠতে হলে যে এটিকেট লাগে সেই ঘাটতি থেকেই যাবে। বোদ্ধা/ ক্রিটিকস সর্বযুগে সর্বক্ষেত্রেই সংখ্যালঘু, ম্যাস পপুলেশন বরাবরই গ্রস চিন্তা করে বা গ্রস দৃষ্টিতে পৃথিবীকে, সেভাবেই বাঁচে, এবং ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, এরাই ডিসিশন মেকিং রোল প্লে করে; বোদ্ধা/ক্রিটিকস একটি হাইপোথেটিকাল এজাম্পশন, বাস্তবতার সাথে যার দেখা মেলে না সহসা। তাই চার বা ছক্কা হলো কিনা, বোলার দাগের মধ্যে রেখে বল ডেলিভারি দিলো কিনা, এবং খেলায় জয়লাভ করলো কিনা এটুকু সম্পর্কে সজাগ থেকেই ক্রিকেট দেখা যায়, আর কিছু লাগে না। একারণে, বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের সময় মনে হয় বলে বলে রান হয় না কেন, একটা বাউন্ডারি হলে চিৎকার, কিন্তু বিপক্ষ দল ব্যাটিংয়ে নামলে প্রতি বলে উইকেট দেখতে মন চায়, পার্টনারশিপ গড়লে টিভি বন্ধ করে অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। মনের এই ইরেশনাল বিহেভিয়ার অনিয়ন্ত্রিত, ম্যাচিউরিটির বালাই নেই সেখানে; স্নায়ুর চাপ নিতে পারে না ৯০% বাঙালি, ম্যাচিউরিটির আশা করাটা তাই গুলিস্তানে বিমান বিক্রির মতো ব্যাপার। তার চাইতে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ, এই সান্ত্বনায় বা ফেক কনফিডেন্সে দর্শকরা যদি আরও বেশি করে ম্যাচ দেখতে চায়, ক্রেজি হয়ে উঠে, তাতে বিসিবির আয় বাড়বে, ক্রিকেটাররা ক্যারিয়ার শেষে শিল্পপতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে; মন্দ কী!
টেস্ট এরিনায় বাংলাদেশের গ্রোথকে ধোনি পূর্ববর্তী ভারতের ধরনের সাথে মেলানো যায়। অনিল কুম্বলে দিনভর বোলিং করতো, পেস বোলারদের কাজ থাকতো বলের শাইনিং নষ্ট করা, যে কারণে নিজ মাটিতে ভারত বরাবরই দুর্ধর্ষ ছিলো। গত বছর থেকে টেস্টে বাংলাদেশ যা সাফল্য পাচ্ছে পুরোটাই স্পিন রেসিপি, শ্রীলংকায় একটি টেস্ট জিতেছে, এবং মুস্তাফিজ ৪ উইকেট পেয়েছে, তবু ডমিনেন্স ফ্যাক্টর বিবেচনায় নিলে স্পিন কৌশলটাই চোখে পড়ে প্রবলভাবে। জয় মানে জয়, সেটা দেশে নাকি বিদেশে এটা অবান্তর প্রসঙ্গ, কারণ নিজেদের মাটিতেই ইনিংস ব্যবধানে হারার ইতিহাস খুব পুরনো নয়; তখন কথা না উঠলে জেতার পর এসব প্রশ্ন উত্থাপন করাটা হীন মানসিকতা। অনিল কুম্বলে যুগের ভারত এখন উমেশ যাদব, সামি আহমেদ, বুমরা, ভুবনেশ্বরের মতো পেসার পেয়েছে যাদের কোয়ালিটিকে উপেক্ষা করার জো নেই। ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেট বলতেই আমজনতা বোঝে আইপিএল, জানে না রঞ্জি ট্রফির মতো শক্তিশালী আসরের কথা। ইএসপিএন এ ক্রিকেট এনালাইসিস সংক্রান্ত যেসব অনুষ্ঠান হয়, অন্তত তার কাছাকাছি মানের কোনো প্রোগ্রাম আজ অব্দি চোখে পড়লো না আমাদের এদিকে। গাজী টিভি ক্রিকেটে যথেষ্ট আগ্রহী, পাবলিক পালস তারা বোঝে, কিন্তু কোয়ালিটি কনটেন্ট কোথায়? ক্রিকেট প্রোগ্রাম মানে সাবেক বা জাতীয় দলের বাইরের ক্রিকেটারদের নিয়ে টকশো; এই প্রবণতা থেকে কি ইন্টেলেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট সম্ভব? ১৯৩১ সালে টেস্ট খেলা শুরুর পর একজন গাভাস্কারকে পেতে ভারতকে অপেক্ষা করতে হয়েছে প্রায় ৪০ বছর, অন্যদিকে টেস্ট খেলার ৭ম বছরের মাথায়ই আমরা পেয়ে গেছি তামিম ইকবালকে; সাংখ্যিকভাবে মনে হতে পারে, ভারতের চাইতে আমাদের প্রোগ্রেস রেট অনেক সন্তোষজনক। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে একটু একটু করে যা গড়ে উঠে তার থাকে স্থায়ী ইতিহাস এবং ঐতিহ্য, চট করে ঘটে যাওয়া ঘটনায় সেগুলো থাকে অনুপস্থিত। ২০০০ সাল পরবর্তী পৃথিবীতে সবকিছুই খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে, আগে জেনারেশন গ্যাপ বলতে ১৫-২০ বছরের ব্যবধান থাকতো, এখন ১ বছর ব্যবধানেই জেনারেশন গ্যাপের সৃষ্টি হওয়া অবস্থা। সেক্ষেত্রে ভারত বা নিউজিল্যান্ড যে গতিতে এগিয়ে বর্তমান পজিশনে পৌঁছেছে, বাংলাদেশের পক্ষে সেই পরিমাণ সময় ইনভেস্ট করার অবকাশ নেই, তাই ম্যাচিউরিটি ব্যাপারটা সোস্যাল স্ট্রাকচার, ইন্টেলেকচুয়াল ইনোভেশনের মধ্য দিয়ে আনা যেত। কিন্তু ক্রিকেট এখানে প্রচণ্ড পলিটিক্যাল, একজন এমপি বা মন্ত্রীকে যতবার টিভিতে দেখা যায়, বিসিবি প্রেসিডেন্ট টিভিতে আসেন তার চাইতে অনেক বেশি, জীবনে একটিও ক্রিকেট সংগঠন না চালিয়েও স্রেফ পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডের সূত্র ধরে বিসিবিতে নীতিনির্ধারক হওয়া যায়; এরা ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট স্কিমের মর্মার্ধ ধরতে পারবে এটা দুরাশা।
তবে বিসিবিতে প্রখর ক্রিকেট মস্তিষ্কের লোক নেই এটা একেবারেই বলা যাবে না। বেশ কয়েকমাস আগে সাকিব আল হাসান আর তামিম ইকবালকে নিয়ে পোস্ট লিখেছিলাম, সেসূত্রে পরিচয় হয় বিসিবির অন্যতম কোচ নাজমুল আবেদিন ফাহিম স্যারের সাথে, একদিন দীর্ঘ আলোচনাও হয় আমাদের। তার ক্রিকেটপ্রজ্ঞায় শুধু মুগ্ধ হই বললে ভুল হবে, নিজের চিন্তাকে সমৃদ্ধ করার বিশদ রসদ খুঁজে পাই। এরকম একজন মানুষ যার হওয়া উচিত ছিলো জাতীয় দলের কোচ, তিনি কাজ করছেন কী নিয়ে! বাংলাদেশের ক্রিকেট বুনিয়াদ তাদের মতো কয়েকজন সমাজের চোখে ট্র্যাকচ্যুত মানুষের অবদানে অধিষ্ঠিত, কিন্তু আদৌ কি মূল্যায়ন করা হয়েছে তাদের? জয়ের জন্য প্রয়োজন সাহস, বিশ্বাস করা এবং প্রচুর এক্সাম্পল। নাফিস ইকবাল, আশরাফুলদের ব্যাচ যখন গড়ে উঠছিলো, বয়সভিত্তিক খেলাগুলোতে বড় দলগুলোর সাথে সমানে সমানে ফাইট দিচ্ছিলো, তখনই অনুমান করা যাচ্ছিলো সামনে ব্যবধান কমে আসবে। নাফিস, আশরাফুল, মাশরাফি বা সাকিবদের তৈরি করেছেন কারা? ফাহিম স্যার, ইমরান স্যার বা অন্য কোনো দেশি কোচ, নাকি অস্ট্রেলিয়ান রিচার্ড ম্যাকিন্স, যিনি একদা মন্তব্য করেছিলেন বাংলাদেশে কোনো কোচ নেই! প্রাথমিক আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হয়তোবা বিদেশী কোচের প্রয়োজন ছিলো, কারণ ২০০ বছরের ঔপনিবেশিকতা আমাদের মধ্যে প্রায় গেঁথে দিয়েছে বিদেশী মানেই ডাকসাইটে কিছু একটা। যে কারণে উপমহাদেশের ৪টি দলেই বিদেশী কোচ নেয়ার সংস্কৃতি চালু ছিলো; ভারত সরে এসেছে বেশ কিছুদিন হলো, পাকিস্তান সরে আবার ফিরে আসে, শ্রীলংকাও তা-ই। সেই কোচগুলো কোন্ দেশের? অস্ট্রেলিয়া, অথবা দক্ষিণ আফ্রিকার, অথচ অন্য দেশগুলোতে উপমহাদেশের কোনো সাবেক ক্রিকেটারকে কোচ করা হয় না। মুশতাক আহমেদ কিছুদিন ইংল্যান্ডের স্পিন বোলিং কোচ ছিলেন, কিন্তু সেটা পাকিস্তানী পরিচয়ের চাইতে কাউন্টি খেলার অভিজ্ঞতাই মূখ্য কারণ। শেন জার্গেনসন, হাতুরিসিংহ- এরা খেলোয়াড় হিসেবেও মিডিওকর, কোচ হিসেবেও তা-ই; কিন্তু তাদের হাতে এখনো বাংলাদেশ ক্রিকেটের দণ্ডমুণ্ড, কারণ অস্ট্রেলিয় সার্টিফিকেট। হাতুরি যাবেন, কোনো এক বাটাল আসবেন অস্ট্রেলিয়া বা ইংল্যান্ড থেকে, কিন্তু দেশের কোনো কোচকে সরাসরি জাতীয় দলের দায়িত্ব দেয়া হবে, এ তো অন্ধের পূর্ণিমাদর্শন! সেই অভিষেক টেস্টে জাতীয় দলের আপৎকালীন কোচ ছিলেন সারোয়ার ইমরান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল খেলা ছাড়ার পর পুরোদস্তুর কোচিংয়ে আছেন, পেসার সাইফুল ইসলাম কোচ হয়ে গেছেন; তবু তারা সিলেবাসের বাইরে থাকবেন, যেহেতু তাদের সময়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশ হাসির পাত্র ছিলো। এই দেউলিয়াত্বের দায় কে নিবে! ক্রিকেট প্রজ্ঞা, স্ট্র্যাটেজি, গেমপ্ল্যান কোনো এঙ্গেলেই কি হাতুরিসিংহ জাতীয় কোচরা নাজমুল আবেদিন ফাহিম, সারোয়ার ইমরান বা আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সাথে কম্পিটি করার সামর্থ্য রাখে? অথচ দেশি কোচদের পরিশ্রমে গড়ে তোলা ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্সের কৃতিত্ব চলে যাবে হাতুরুদের সিভিতে, পকেটে ঢুকবে লক্ষ লক্ষ টাকা।
ক্রিকেট জার্নালিজমটাও ম্যাচিউরিটির সাথে কানেক্টেড। বাংলাদেশ ক্রিকেটের মিডিয়া স্পোকসম্যান বলতে আমি বুঝি উৎপল শুভ্রকে; ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যারিয়ার ছেড়ে সেই ১৯৮৯ সালে স্পোর্টস জার্নালিজমের মতো একটি চরম আনপ্রোডাক্টিভ সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়ার জন্য কতটা স্পোর্টস লাভিং মাইন্ড থাকতে হয়, সেটা বুঝতে হলেও রেশনাল এবং লজিকাল মানসিকতা থাকা দরকার। লোকাল স্টার কনসেপ্ট বিল্ড আপ, স্টোরি টেলিং ফরম্যাটে রিপোর্টিং সবকিছুর জন্যই তিনি কৃতিত্ব পান, কিন্তু ম্যাচিউরিটির নির্মম বহিঃপ্রকাশে অনলাইন কমিউনিটিতে উৎপল শুভ্র একটি স্ল্যাংয়ের নাম। পক্ষান্তরে, ক্রিকেটদূত বা ক্রিকেটপীর হয়ে গেছেন একদা তার সাথে কাজ করা বয়সে জুনিয়র বহু জার্নালিস্ট। পলিটিক্যাল সেনসিটিভিটি বাংলাদেশের সর্বত্র; সেটা ঘর মোছা হোক, কিংবা বিমান চালানো হোক; এখানে ‘ভালো লাগা থেকে করা’ বলতে কিছু নেই। তাহলে ম্যাচিউরিটি কি শূন্যে ঘর বাঁধবে! ম্যাচিউরিটি তো একক কোনো অর্জন নয়, এটি একটি সামষ্টিক ও সামগ্রীক আচরণের সমণ্বিত বহিঃপ্রকাশ।
‘ফেয়ার প্লে’ শব্দটা যেখানে সমগ্র পৃথিবীর কোথাও এক্সিস্ট করে না, ইনজাস্টিসই যখন স্বাভাবিক, সেখানে প্রাপ্যতার হিসাব করা অর্থহীন। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ক্রিকেট একটি সাময়িক হাইপ, যেটা আর বড়জোর এক দশক স্থায়ি হবে অনুমান করছি, সেই সেক্টরে ম্যাচিউরিটি আশা করাটা অমূলক। ইউটিউব চ্যানেল খোলা, অনলাইন স্কুলিং, এফ কমার্স প্রভৃতি হাইপগুলোর কাছে ক্রিকেটও একসময় জায়গা ছেড়ে দেবে। হয়তোবা জিম্বাবুইয়ে বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের মতো দেউলিয়া হবে না, কিংবা কেনিয়ার মতো ডুবে যাবে না, কিন্তু কোনোদিন অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো দৃষ্টান্তও স্থাপন করতে পারবে না, এটা দেড়শো টাকার স্ট্যাম্পে যে কোনো শর্তেই লিখে দেয়া যায়।
যে দেশে ৩য় শ্রেণির কর্মচারী পদে চাকরির জন্য ১০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়, চিকিৎসকের ভিজিট ১২০০ টাকা, চালের দাম ৭০ টাকা, হিরো আলমকে নিয়ে কভার স্টোরি ছাপা হয়; সেই দেশে হাইপ-ই সার্থকতা আর সফলতার সীমানা নির্ধারণী লাইন হয়ে টিকে থাকবে চিরকাল, অন্য সবকিছুই আসা-যাওয়ার মধ্যে হারিয়ে ফুরিয়ে বুড়িয়ে যাবে। ক্রিকেটের মতো এতো বৈচিত্রময় একটি খেলাও এই হাইপ-হুজুগের ঘেরাটোপে ঢুকে পড়লো এটা সত্যিই মনোবেদনা বাড়ায়।
হাইপের পাইপে চড়ে ম্যাচিউরিটির ঘাড় মটকে দেয়ার জন্য যে বা যারা তৈরি হচ্ছেন বা আছেন, সবার জন্য নো বল এ ফ্রি হিট উপহার!